আমাদের গ্যাংটকে গন্ডগোল
- NM84 Members
- Apr 4, 2021
- 4 min read
আমাদের গ্যাংটকে গন্ডগোল
সোমা সরকার
গ্যাংটকে গন্ডগোল এই কথাটির সঙ্গে আমরা বাঙালীরা পরিচিত।এই পরিচয় আমাদের করিয়ে দিয়ে গেছেন বিশ্ববরেণ্য ভারতরত্ন শ্রী সত্যজিত রায়। চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক, লিপিকলাবিদ, অঙ্কনশিল্পী, লেখক, শিল্পনির্দেশক নানাভাবে ওনাকে আমরা চিনি। সত্যজিত রায়ের জন্মশতবর্ষে ওনাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।
আমার এই কাহিনীর কুশীলব আমরা, মানে আমি এবং আমার ভ্রমন সঙ্গীরা। বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে দেখা যায় কিছু কিছু জায়গায় কিছু কিছু মানুষের গিঁট থাকে। আমার ক্ষেত্রেও এমন দু একটি জায়গা আছে। তার মধ্যে গ্যাংটক একটি। ঘরের কাছে এমন সুন্দর একটি জায়গা যখনই যাবার চেষ্টা করি একটা না একটা বাধা এসে দাঁড়ায়।
আমার স্বামী একবার অফিসের কাজে গ্যাংটক গেছিলেন, হোটেলে ঢুকে যেই ফ্রেশ হতে যাবেন ধরনী কেঁপে উঠল। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের লোকেরা সে যাত্রায় উদ্ধার করে। সারারাত ম্যালে বসে থেকে পরদিন কোলকাতা রওনা দেন।

পরবর্তীকালে যখন আমরা রেশমপথ যাবার পরিকল্পনা করছি আর তাতে গ্যাংটক আছে শুনে আত্মীয়স্বজনেরা আগের কথা মনে করিয়ে সাবধান করে দিল।
আমি বললাম অত ভাবলে চলবে কেন, বারবার কি আর ভূমিকম্প হবে? ভূমিকম্পের আগে ও তো একবার আমার কর্তা বন্ধুদের সঙ্গে ভালোভাবে ঘুরে এসেছে।
নির্দিষ্ট দিনে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। সিলারিগাঁও তে পেলাম প্রকৃতির অপরূপ শোভা। রাতে বৃষ্টি হবার পর সকালে কাঞ্চনজংঘার দর্শন পেলাম। এরপর ঋষিখোলার পাহাড়, জঙ্গল, নদী সব মিলিয়ে অপূর্ব দুটো দিন কাটলো। তারপর অরিতার লেকে বোটে চড়া। পদমচেনে একদিন থাকলাম। এসে পড়লাম জুলুক। এখানে বেশ ঠান্ডা আবহাওয়া, দুইদিকে সবুজ পাহাড়, মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে, দেখে মনে হয় ধোঁয়া উঠছে। ছবির মত সুন্দর পাকদন্ডী পথ। আমাদের বেশ ভালো লাগছিল। জুলুকে একদিন থাকা হল। এরপর আমাদের পরিকল্পনা ছিল জিগজ্যাগ রোড ধরে লুংথুং, নাথাং ভ্যালী, কুপকুপ লেক, ছাঙ্গু হয়ে আমরা গ্যাংটক যাব। আমরা আলোচনা করছিলাম থাম্বি ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে একটা ভালো ছবি তুলবো, জিগজ্যাগ রোডের একটা ভালো ছবি চাই। ছাঙ্গুতে কি কি মজা করবো, ইয়াকের পিঠে চড়া হবে কিনা গ্যাংটকে গিয়ে কি কি শপিং করবো ইত্যাদি।
সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমরা দুটো গাড়ি করে যাচ্ছিলাম। আমি পিছনের গাড়িটায় ছিলাম। ওপর থেকে ছেড়ে আসা জায়গা দেখতে পাচ্ছি, জিগজ্যাগ রোড টা দেখছি দারুণ লাগছে। থাম্বি ভিউ পয়েন্টে নামলাম ছবি তোলার জন্যে। হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি এলো। মোবাইল, DSLR বাঁচিয়ে সবাই তাড়াহুড়ো করে গাড়ীতে উঠে পড়লো। লুংথুং পৌঁছে দেখি বৃষ্টির সঙ্গে কুচি কুচি বরফ পড়ছে। ড্রাইভার ভাই বললো, আর যাওয়া যাবেনা, আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেছে। সামনের গাড়ীর ড্রাইভারকে ফোন করে গাড়ি ঘোরাতে বলে দিল। নিজেও ঘুরিয়ে নিল। ঘটনার আকষ্মিকতায় সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে। ফেরত আসছি, মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
আমি হাল না ছেড়ে ড্রাইভারকে অনুরোধ করতে লাগলাম আর একটু নিয়ে চলো, একটু পরে তো আবহাওয়া ভালো হতে পারে। মাঝে কিছুটা জায়গা পার হয়ে গেলে তো পরবর্তীকালে যেতে আর অসুবিধা হবেনা। সে তো আর কথা শোনেনা। আমরা আবার জুলুক, পদমচেন পার হয়ে নেমে এলাম। লিংতামে এসে দেখলাম বেশ রোদ উঠেছে, ঝকঝকে আকাশ। তখন অন্য দু একজনও অনুরোধ করতে শুরু করলো। এবার ড্রাইভার ভাই রাজী হলো, আবার গাড়ী ঘুরিয়ে যাওয়া শুরু হলো। এর মধ্যে সময় গড়িয়ে গেছে অনেক। আবার পদমচেন, জুলুক পার হয়ে যাচ্ছি। সময় নষ্টের কথা ভেবে আর থাম্বি ভিউ পয়েন্টে নামলাম না। আবার লুংথুং পার হলাম। আবহাওয়া যথেষ্ট ভালো। মনে হচ্ছে আমরা তাহলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

এরপর এলাম নাথাং ভ্যালী। গাড়ী থেকে নেমে সবাই ছবি তুলছি, কফি খাচ্ছে কেউ কেউ। এটা ও মনে হচ্ছে এখানে থাকলে বেশ হতো। কই শ্বাসকষ্ট হচ্ছেনা তো। আবার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। ওমা জল কোথায়, এ তো গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ। সবাই আনন্দে শিশুর মতো লাফালাফি শুরু করে দিলাম। বেড়াতে গিয়ে বরফ তো অনেকবার দেখেছি কিন্তু এমন বৃষ্টির মতো গায়ে পড়ছে, এতো অন্য অভিজ্ঞতা। বাড়ির টিনের ছাউনি, গাছের মাথা, রাস্তা সব বরফের চাদরে ঢেকে গেছে। আমরা VDO করলাম। অত্যুৎসাহী দু একজন পাহাড়ে উঠে ছবি তুলতে লাগলো। এইবার দুইজন ড্রাইভার তাড়া দিলো, বললো যে কোন সময় রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন এতখানি উচ্চতায় সারারাত থাকতে হবে। অনিচ্ছাসত্বেও আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম, গাড়ি চলতে শুরু করলো।
এর মধ্যে অন্য একটি গাড়ি এসে আমাদের দুটো গাড়ির মাঝে চলতে শুরু করলো। একটা বাঁক নিয়ে উপরে ওঠার সময় ঐ গাড়িটা আর কিছুতেই পারলোনা। আমাদের দুই গাড়ির ড্রাইভার রা নেমে ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুতেই হলোনা। ঐ গাড়ীটা ফিরে গেলো। এবার আমাদের পেছনের গাড়ীটাও পার হতে পারলোনা। চাকা স্কিড করতে লাগলো। আমরা গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম,ভাবছি মহা ঝামেলা তো, অন্য কোন গাড়ী যদি এখন এসে পার হয়ে যায়, তাহলে হয়তো আমাদের ড্রাইভারও সাহস পাবে। কিন্তু কারো দেখা নেই।
এরপর দেখি কাছের সেনা ছাউনি থেকে দুজন আসছিলেন, ওনারা আমাদের প্রথম গাড়িতে কিছু বলছেন। এবার নিশ্চয়ই আমাদের যাবার ব্যাবস্থা হবে।

না বিধি বাম। ওনারা ফিরে যেতে বলছেন, আবহাওয়া খারাপ আছে। অগত্যা গাড়ীতে উঠে বসলাম, গাড়ী ফিরে যাবে জুলুকের দিকে, এইবার আবার সমস্যা। আমাদের প্রথম গাড়ীটা বাঁকটা পার হয়ে উপরে উঠে গেছিলো, সে আর ফিরতে পারছেনা। বার বার চেষ্টা করে বিফল হচ্ছে। এইবার রীতিমতো চিন্তা হচ্ছে, অ্যাডভেঞ্চার উড়ে গেছে। সারা রাত এই ঠান্ডায় থাকতে হবে নাকি! বার বার চেষ্টা করে সেনাদের সহায়তায় গাড়ী ঘোরাতে পারলো। আবার ফিরে যাচ্ছি কুপকুপ লেকের কয়েক কিলোমিটার আগে থেকে। ছাঙ্গু ও আর যাওয়া হলোনা। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। জিগজ্যাগ রাস্তা দিয়ে ফিরতে হবে। এখন গাড়ীতে পিন ড্রপ সাইলেন্স। কারো মুখে কথা নেই। খিদে পাওয়ার কথা কিন্তু সবাই খিদে তেষ্টা ভুলে গেছে। জুলুক পার হতে পারলে শান্তি।

জুলুক পার হবার পর মনে হচ্ছে গাড়ীটা যদি আটকে না যেতো দিব্যি চলে যেতে পারতাম গ্যাংটক। এখন এই রাতের অন্ধকারে এত ঘুরে কখন গ্যাংটক পৌঁছাবো কে জানে। সন্ধ্যাবেলার সব প্রোগ্রাম ও মাঠে মারা গেলো। গ্যাংটক পৌঁছাতে রাত হয়ে গেলো। দুরত্ব বেশী হবার জন্যে গাড়ী ভাড়া ও বেশী পড়লো। হোটেল টিবেট থেকে মোমো খেয়ে আমাদের হোটেলে চলে গেলাম। আমাদের সফরসঙ্গী দাদার হোটেল হবার সুবাদে রাতে আমরা বাঙালীরা পছন্দের মাছ ভাত খেলাম, বেশ কয়েকদিন পর। আমাদের হোটেলটা ছিলো MG Marg এর কাছে, পরদিন সকালে হোটেলের ছাদ থেকে গ্যাংটকের স্টেডিয়াম টা দেখতে পেলাম হোটেলের পেছন দিকে। ছাদে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন ও পেলাম। ম্যালের ধারে কিছুটা সময় কাটিয়ে, টুকিটাকি শপিং সেরে সেইদিন ই দার্জিলিং মেল ধরার জন্যে বাই বাই গ্যাংটক, আবার আসবো, বলে চলে এলাম
পরে ভাবি, চোখের সামনে বরফের চাদরে উপত্যকা ঢেকে যাচ্ছে, গায়ে গায়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বরফ পড়ছে, সেটাও তো একটা প্রাপ্তি। সারারাত অতখানি উচ্চতায় ঠান্ডায় যে আটকে পড়িনি সেটাও বা কম কি!

পুনশ্চ: ২০২০ তে 5th April আবার রাবাংলা,নামচি,পেলিং,গ্যাংটক যাবার পরিকল্পনা করে ট্রেনের টিকিট, হোটেল বুকিং যাবতীয় প্রস্তুতি সারার পর কোভিডের অনুগ্রহে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
Comments