top of page

জেন ওয়াই

স্বাগতা বড়ুয়া


ঘড়ি না দেখেও বলে দিতে পারি এখন কাঁটায় কাঁটায় দশটা।

রোজ সকাল দশটা থেকে শুরু হয় সামনের ফ্ল্যাটে রুমির মেয়ের উপর বাক্যিবর্ষণ।

“এতো বেলা অব্দি কেউ ঘুমায়? তোর বাবা অফিসে বেরিয়ে গেল, আমার রান্না প্রায় শেষ, মালতী মাসি কাজ করে চলে গেল, প্রতিদিন তোর জন্য বাসি বিছানা পড়ে থাকে। শ্বশুরবাড়ি গেলে দুদিনেই তাড়িয়ে দেবে, এরকম অলক্ষ্মী মেয়ে নিয়ে কে সংসার করবে?”

এই কটা কথা রুমি শুরু করলেই আমি বাকি টা শেষ করে দিতে পারি। রোজ রোজ একই ফাটা রেকর্ড শুনতে শুনতে আমার ঝরঝরে মুখস্থ হয়ে গেছে।

অথচ ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই মাঝে মাঝে মেয়েটিকে আমি দেখি। আমার কিন্তু বেশ লাগে। আমি অনেক পরে এসেছি এই অ্যাপার্টমেন্টে। একদিন আমার সাথে মেয়েটির চোখাচোখি হতেই আমাকে হাত নেড়ে বলেছিলো “হাই আন্টি, তোমরা নতুন এলে?” আমি হাসিমুখে বললাম “হ্যাঁ”। তখন ও অনেকটা ছোটো। তারপর থেকে যতবার দেখা হয়েছে, কি সুন্দর মিষ্টি হাসি হেসে হাত টা নাড়ায়। আমার খুব ভালো লাগে ওর এই ছটফটে মিশুকে স্বভাবটা।

আমার পাশের ব্যালকনি থেকে মাঝে মাঝে কথা হয় সোপু দির সাথেও। সোপু মানে সুপর্ণা। ঊনি আবার সবার ব্যপারে ভীষণ আগ্রহী। রোজ সকালে মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে প্রচুর নতুন নতুন খবর কালেকশন করে আনেন। আমার কত্তামশাইটি অফিসে বেরোনোর সাথে সাথেই আমার কলিংবেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। কতক্ষণে ফ্ল্যাটের সবার ভাতের হাঁড়ির খবর গুলো ঊনি ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে দেবেন। ক’দিন বেশ আসা যাওয়া করলেন। আমার থেকে হ্যাঁ, না, রাম, গঙ্গা কোনো জবাব না পেয়ে অবশেষে হতোদ্যমী হয়ে এখন আমার ঘরে আসাটা একটু কমিয়েছেন।

সেদিন সন্ধ্যের মুখে টুকটাক কিছু জিনিস আনতে একটু বেরিয়ে ছিলাম। ফেরবার সময় সোপুদির সাথে দেখা। ভাবলাম পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবো, তা আর হলো না। দেখা হওয়ার সাথে সাথে “কি গো কেমন আছো? পাশাপাশি থাকি, অথচ সেভাবে দেখাই যায় না তোমাকে। “

মনে মনে ভাবলাম, আপনার সাথে দেখা হওয়া মানেই তো শুধু লোকের সমালোচনা। না দেখা হওয়াই ভালো। কিন্তু মুখের উপর তো আমি অতো বলতে পারি না। অগত্যা দেঁতো হাসি হেসে বললাম, “হয়তো আমি যখন বাইরে বেরোই, তখন আপনি বেরোন না”। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো, “তুমি যখন বেরোবে আমাকে একবার ফোন করে দেবে, আমি তোমার সাথে দুটো প্রাণের কথা বলবো”।

মুখ দিয়ে ‘করুণাময়ী রানী রাসমণি’ র বিখ্যাত ডায়লগ “রক্কে করো রঘুবীর” –বেরিয়ে আসছিল।

আমরা কথা বলতে বলতে আমাদের গলির মুখে আসতেই পেছন থেকে হনহনিয়ে হেঁটে আসছিল রুমির মেয়ে 'তন্বী'। আমাদের দেখামাত্রই হাত নেড়ে বলল, আন্টি ভালো আছো তো তোমরা? আমি বললাম, “হ্যাঁ ভালো আছি”।

আমাদের সাথে পিছনে ঘুরে কথা বলতে গিয়ে খুব জোরে হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরলাম। ও সাথে সাথে বলল “চিল আন্টি, কিচ্ছু হয় নি”। আমি বললাম, “একটু আস্তে আস্তে চলাফেরা করো মা, এতো তাড়াহুড়ো কোরো না”। ও বললো, “আর বোলো না আন্টি, কলেজ থেকে এসে একটু ল্যাদ খাচ্ছিলাম, কিন্তু মার তো তর সয় না, বলল এখুনি দোকান থেকে পান, কলা নিয়ে আয়। কালকে বৃহস্পতিবার, তাই কোনো রকমে দৌড়ে বেরিয়ে আসলাম। এক্ষুনি আমাকে একটা কাজে বেরোতে হবে। মার কাজটা করে না দিয়ে গেলে একেবারে ক্ষেপে খুলখুল হয়ে যাবে”, বলেই মুক্তোর মতো হাসি ছড়িয়ে এগিয়ে গেলো।

সোপুদি যেন এইজন্যই অপেক্ষা করছিল, ও যাওয়ার সাথে সাথে বলল, “দেখেছো পোষাক আষাক! লজ্জায় তাকাতে পারছিলাম না। একটা হাফপ্যান্ট আর হাতকাটা গেঞ্জি পরে একবারে দোকানে চলে এসেছে? এইসব মেয়েরাই রাস্তা ঘাটে রেপড্ হয়। ওর মা কি চোখ বন্ধ করে থাকে? সেদিন তো দেখলাম রাত এগারোটার সময় একটা ছেলের বাইকে চেপে ঘরে ফিরলো। ছিঃ ছিঃ ছিঃ, আমাদের বাড়ির মেয়ে বৌ হলে না মাটিতে পুঁতে দিতাম”।

“আমার বৌমা কে তো দেখেছো, রাতে ছাড়া কখনোই নাইটি পরে না। আমাদের বাড়ি তো একটু গ্রামের দিকে, গুরুজনদের সামনে এইসব পোষাক আষাক ভাবতেই পারি না। এখন ছেলে বৌমা দুজনেই বাইরে থাকে। ওখানে যা খুশী পরুক আমি তো আর দেখতে যাচ্ছি না”। আমি হাসতে হাসতে বললাম, “এই ইয়ং জেনারেশনকে নিয়ে আপনি এতো মাথা খারাপ নাই বা করলেন। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের মা দের সাথেও তো আমাদের মানসিকতা র অনেক ফারাক ছিল। যুগের সাথে সাথে নিজেকে মানাতে পারলে ভালো, নয়তো যুগ আপনাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে”। একটু যেন বিরক্ত হলো। সাথে সাথে চলে গেল অন্য পয়েন্টে। “দেখলে কেমন বাজে কথা বললো, ল্যাদ খাচ্ছিলাম। এসব কথা কোনোদিন শুনেছো?”

আস্তে আস্তে আমার মাথাটা গরম হচ্ছিল, বলেই ফেললাম, “আপনি শোনেন নি বলে কি ওদের কলেজের ভাষা তৈরী হবেনা? আপনি আপনার মতো সমবয়সীদের নিয়ে থাকুন না, তাদের সাথে আপনার মনের মিল হবে। শিং ভেঙ্গে ঐসব বাছুরদের ভাষা নাই বা শুনলেন। বাসে ট্রামে যখন ওঠেন তখন কজন আপনার সমবয়সী সিট ছেড়ে আপনাকে বসার জায়গা দেয়? দেয় তো এই হাতে মোবাইল, কানে হেডফোন, চুলে স্পাইক করা অথবা লাল নীল সবুজ রং করা এইসব নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। তাহলে ওদেরকে নিয়ে এতো কথা কেন?”

তখনকার মতো একটু দমে গেলো। জানি কদিন পরেই আবার শুরু করবে নতুন কোনো ইস্যু নিয়ে। আমি ওনাকে একবার বলেছিলাম, “আপনার ফেসবুক হোয়াটসআ্যপ এগুলো খুলে দেবো, আপনি ওগুলো নিয়ে থাকবেন। দাদা তো অফিসের কাজে সারাদিনই বাইরে থাকেন, আপনার সময় কেটে যাবে। একাকীত্ব দুর হবে”। চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। ওনার ছেলে কতো ভালো একটা স্মার্ট ফোন কিনে দিয়েছে। ঊনি শুধু লাল আর সবুজ এইদুটো বোতামের কাজ জানেন।

আজ সকাল থেকেই আমাদের খুব তাড়াহুড়ো। মেয়ের কাছে যাবো। কর্মসূত্রে মেয়ে থাকে পুনেতে। দুপুর দুটো কুড়িতে ফ্লাইট। অন্ততঃ ঘন্টা দুয়েক আগে পৌঁছতে হবে এয়ারপোর্টে। আমার কর্তার আবার সব ব্যাপারেই তাড়া দেওয়া অভ্যাস। ওনার ধারণা মেয়েদের আগে থেকে তাড়া না দিলে ওরা নাকি যাবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সাজুগুজু আর গোছগাছ চালাতেই থাকে।

মেয়ের কাছে বেশ কদিনের জন্য যাচ্ছি বলে আশেপাশের সবার সাথে একবার দেখা করে বেরিয়ে এলাম।

গাড়িতে মালপত্র তোলার সময় দেখলাম, তন্বী একটি ছেলের সাথে বাইকে চেপে কোথাও বের হচ্ছে। ওর মা ভেতর থেকে চিৎকার করেই যাচ্ছে। একটু হাসি ও পেল। আমার কাছে এসেই জিজ্ঞেস করলো, “আন্টি দিদিভাই এর কাছে যাচ্ছো? যাও খুব এনজয় করে এসো”।

আমার মুখ ফসকে হটাৎ বেরিয়ে গেলো, “তুমি কোথায় যাচ্ছো? কলেজে?” সচরাচর কেউ নিজে থেকে না বললে আমি উপযাচক হয়ে জিজ্ঞেস করি না।

গাড়ির স্টার্ট টা ততক্ষণে বন্ধুটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। তন্বী আস্তে আস্তে বললো, “না আন্টি, আমি যাচ্ছি একটা থ্যালাসেমিয়া পেশেন্টকে ব্লাড দিতে। আমার O-ve, এটা খুব rare group তো, তাই যখনই কারুর প্রয়োজন হয় আমি আর আমার এই বন্ধু ছুটে যাই। সেদিনও তো দিয়ে এসেছি অনেক রাতে। মাকে বলি নি। মা জানতে পারলে খুব অশান্তি করে। আসলে বাবা অফিসের কাজে প্রায়ই বাইরে থাকে বলে মা আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা করে । তাই এতো চিৎকার চেঁচামেচি তোমরা সব সময় শুনতে পাও”।

আজ প্রায় তিনমাস পর আবার ফিরে যাচ্ছি মেয়ের কাছ থেকে। ফেরার সময় আমার একাই ফেরার কথা। কর্তা তো দশদিন পুনেতে কাটিয়েই ফিরে গেছেন। এয়ারপোর্ট থেকে ঊনি নিয়ে যাবেন।

বাড়ি ফেরার পথে কর্তা বলতে শুরু করল, “জানো তো গত মাসে তিমিরদা মানে তোমার ওই সোপু দির বর সন্ধ্যাবেলা হাঁটতে বেরিয়ে ছিলেন। গলির মুখে ঢোকার সময় উল্টো দিক থেকে আসা মারুতি ভ্যানের সাথে খুব বড়ো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টর গার্ড আর আমরা দু চারজন মিলে তৎক্ষণাৎ ওনাকে হসপিটালাইজড্ করি, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। ব্লাড ব্যাঙ্কে দৌড়াদৌড়ি করেও রক্ত জোগাড় করাওতো চাট্টিখানি কথা নয়। তারপর ওনার ব্লাডগ্রুপ O-ve। হঠাৎ মনে পড়ল আমরা যেদিন মেয়ের কাছে যাচ্ছিলাম, সেদিন তুমি বলেছিলে ঐ মেয়েটির ব্লাড গ্রুপ O-ve। আমি সাথে সাথে ওনার মিসেস কে বললাম, সামনে বাড়ির মেয়েটি ও তার বন্ধু O-ve. সেই কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে পাগলের মতো ছুটে গেলেন ওনার মিসেস। মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে তৈরী হয়ে হসপিটালে চলে গেল। সাথে আরও দুজন কে জোগাড় করে নিলো। আমরা দেখে অবাক। কতো অ্যাকটিভ। এখন তিমির বাবু অনেক টাই ভালো আছেন। তুমি পৌঁছে একটু রেস্ট করে ওনাদের সাথে একবার দেখা করে এসো।“

বাড়ি পৌঁছে একটু পরেই সোপুদির ডোরবেল বাজাতেই সোপু দি নিজেই দরজা খুলে আমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো। বসতে না বসতেই বললো, “এই সামনের ফ্ল্যাটের তন্বী র জন্যই আজ তোমাদের দাদাকে ফিরে পেলাম। সেই অ্যাকসিডেন্টের প্রথম দিন থেকেই মেয়েটা যেভাবে আমাদের জন্য ছোটাছুটি করলো। আমার পেটের ছেলে এসেও অতো দৌড়াদৌড়ি করে নি।“

মনে মনে ভাবলাম, এই ফুলের মতো নিষ্কলঙ্ক মনের মেয়েটিকে নিয়ে প্রতিদিন কতো কথাই না বলতেন আপনি। ওর পোষাক আষাক, ওর ভাষা সবই নাকি অশ্লীল। ওদের বাইরের পোষাক নিয়ে কতো চুলচেরা বিশ্লেষণ।

এইতো মেয়ের কাছে গিয়েও কতোবার যে শুনলাম , ‘ল্যাদ খাচ্ছি, একটু পরে উঠবো’। কথায় কথায় বলছে ‘চিল করো’। ওদের এই কথাগুলো আমি খুব এনজয় করে শুনি।

আসার সময় বললাম, তোদের এই শব্দগুলোর মানে লিখে আমাকে একটু হোয়াটসআ্যপে পাঠিয়ে দিস তো। আমি ও বলবো আমাদের বন্ধু বান্ধব কে।

শুধু জিজ্ঞেস করলাম, “এই ল্যাদ খাওয়া মানে টা একটু বল তো আমায়”। সেই শুনে মেয়ে হেসে বলল, “এর মানে আলসেমি। ইংরেজিতে lethargic”



 
 
 

Comments


bottom of page