পথ অবরোধ
- NM84 Members
- Apr 15, 2021
- 8 min read
অতনু চৌধুরী
-কন্ডাক্টর, এটা বাস চলছে, না কি গরুর গাড়ি?
-ভাড়া কিসের দিয়েছেন?
-ভাড়া তো বাসেরই দিয়েছি! কিন্তু এটা কি বাস চলছে?
-ভাড়ায় যখন ভুল করেননি চুপচাপ বসুন, ঠিক পৌঁছে যাবেন।
-ইয়ার্কি হচ্ছে? আমরা ভাড়া দিয়ে বাস এ চেপেছি কি তোমার রসিকতা শুনতে?
-দাদা, ভাড়াই তো দিয়েছেন, বাস টা তো কেনেন নি! সামনে জ্যাম আছে। তাড়া থাকলে ট্যাক্সি ধরে নিন। হাওড়া- হাওড়া- রুবি- সায়েন্স সিটি- পার্ক সার্কাস- ধর্মতলা-
কন্ডাক্টর নিজের মতন প্যাসেঞ্জার তোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে জানে দু একজন প্যাসেঞ্জার এর সবসময় তাড়া থাকে। কিছু কিছু কটু বাক্য ও এদিক ওদিক থেকে ছুটে আসবে! সব কথার উত্তর দিলে নিজের কাজ আর করা হবেনা।
আগের ভদ্রলোক নিজে নিজেই বকবক করতে থাকেন -ভাড়া দিয়ে যাবো, কিন্তু প্যাসেঞ্জার এর কিছু বলার অধিকার নেই। ট্যাক্সি তে যাবো না কি হেলিকপ্টার এ সেটা তোমায় জ্ঞান দিতে হবে না। এখনই পিছনের বাস এসে গেলে তখনই জ্যাম ট্যাম সব হাওয়া হয়ে যাবে। প্যাসেঞ্জার পড়লো কি মরলো আর দেখবে না, রেষারেষি করতে গিয়ে কোথায় নিয়ে ফেলবে কোনো ঠিক নেই।
-আরে দাদা, এসব রাজ্য সরকার এর জন্য। যেদিন থেকে সরকার ইউনিয়ন তৈরী করেছে সেদিন থেকে প্যাসেঞ্জার এর ইচ্ছে অনিচ্ছে সব মারা গেছে। অন্য আর এক যাত্রী আগের ভদ্রলোক এর সঙ্গে সঙ্গত করে ওঠেন।
-কি যে বলেন দাদা, রাজ্য সরকারের কি দোষ? সব কিছুর মূলে ওই কমিশন প্রথা। ওটা বন্ধ না করলে কিছুই হবে না। সরকার তো কবে থেকেই ড্রাইভার কন্ডাক্টর দের মাস মাইনে প্রথা চালু করতে বলছে, কিন্তু মালিক পক্ষ শুনলে তো! ওনারা তো আবার সব ওই বুর্জোয়া গোষ্ঠী, বিরোধী পক্ষের লোক। সব কিছুতে রাজ্য সরকার কে গালাগালি দেওয়াটা আপনারা অভ্যাস করে ফেলেছেন। সরকার পক্ষের এক কট্টর সমর্থক বাসের ভিতর থেকে ফোঁস করে ওঠেন।
-কেন? আপনাদের সরকারী বাসের কর্মীদের কি কমিশন প্রথা তুলে দিয়েছেন না কি? সেখানে তো দিব্যি চলছে।
-হ্যাঁ আছে, কিন্তু ওরা মাইনে টা ও পায়। আর এদের দেখুন, রাস্তায় বেরিয়ে সিগনাল ভেঙে দোষ করবে ড্রাইভার, আর গুনাগার দেবে মালিক, তাহলে বাস তো এইরকম ই চলবে।
-সেটা তো আপনাদের পার্টি ইউনিয়ন এর চাপে দিতে হচ্ছে। কোনো মালিক স্বেচ্ছায় দেয় না কি?
-তাহলে আপনাদের মালিক পক্ষের পার্টি বাস কর্মচারীদের মাস মাইনের বিরোধিতা করলো কেন? সরকার তো মাইনে ও দেয়, ইনসেনটিভ ও দেয়। কিন্তু সিগনাল ভাঙলে তার ফাইন ড্রাইভার কে ই দিতে হয়।
-দেবে না কেন? ওরা মাইনে পায়, ইনসেনটিভ পায়, পি এফ, গ্র্যাচুইটি, পেনশন আছে। এদের কি আছে? মালিক দেখবে না তো কে দেখবে? আপনাদের দল না কি শ্রমিক দরদী, তাহলে উল্টোপুরান শুনছি কেন?
ক্রমশঃ বাসে যাত্রী দের মধ্যে তরজা বেড়ে চললো। বাস এখন এগোচ্ছে না পিছোচ্ছে সেদিকে কারো কোনো খেয়াল নেই। গতি এখন অতি মন্থর।
কন্ডাকটার বুঝে গেছে এখন যাত্রীরা নিজেরাই লড়ে যাবে। ওসবে তার কান না দিলেও চলবে। বাঙালি বিপ্লবীর জাত, বিদ্রোহটা ওদের রক্তে মিশে আছে। তাই বাড়ি থেকে অফিস সর্বত্র বিদ্রোহ - চলছে না চলবে না, ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও। সেই বিদ্রোহের আগুন বাস যাত্রীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। আসল জায়গা থেকে সরে গিয়ে তারা এখন একদল বাস কর্মচারীদের পক্ষে, অন্য দল সরকার পক্ষের হয়ে গলা ফাটিয়ে যাচ্ছে। নির্দল কিছু লোক শ্রোতার ভূমিকায়। বেশ কিছু লোক এসবে কান না দিয়ে বাস থেকে নেমে পায়ে হেঁটেই রওনা দিয়েছে । এরা সবাই সুবিধাবাদী। জগত সংসারে জোয়ারে গা ভাসিয়ে চলাই এদের নীতি।
বাস এখন আগের থেকে অনেক ফাঁকা। দু'চারটে বসার সিট ও খালি। রজত এতক্ষণ মন দিয়ে সহযাত্রী দের ঝগড়া শুনছিল। তার কাছে ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্য লাগছে। এই লোকগুলোর গন্তব্যে পৌঁছানোর আদৌ কোনো তাড়া আছে কিনা সে ব্যাপারে তার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তার নিজেরও বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই। বরং যত দেরী হবে ততটাই তার সুবিধা। সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। বাস এতক্ষণ যাও বা গড়িয়ে গড়িয়ে চলছিল, এবার একদম দাঁড়িয়ে পড়ল। বাদাম - নোনতা বাদাম - মুগডাল ভাজা - মটর ভাজা -- দাদা বৌদিরা চুপচাপ না বসে টুকটাক চালিয়ে যান - প্যাকেট মাত্র দু টাকা…. ।
-ও ভাই বাদাম, কি ব্যাপার গো, গাড়ি চলছে না কেন? এক যাত্রী প্রশ্ন করেন।
-দাদা সামনে জ্যাম আছে। বাদামওয়ালা জবাব দেয়।
-অনেক দেরি হবে নাকি গো?
-বলতে পারবোনা। দু টাকার বাদাম কিনে চিবোতে থাকুন, টাইম পাস হয়ে যাবে।
-আমি মরছি আমার জ্বালায়, আর উনি এসেছেন বাদাম কিনে টাইম পাস করার জ্ঞান দিতে।
বাস এবার স্টার্ট বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে লম্বা গাড়ির লাইন। যাত্রীদের মধ্যে চঞ্চলতা আবার বৃদ্ধি পেল। সকলে জানলা দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে বোঝার চেষ্টা করছে। সত্যিই গাড়ি আর এগোবে নাকি এখানেই দেহ রাখলো।
রজত বাদাম ওয়ালা কে ডেকে এক প্যাকেট বাদাম কিনলো। -কি গো কি বুঝছো? প্রশ্ন করে বাদাম ওয়ালা কে।
-দাদা কি আর বুঝবো? সামনে হেব্বি জ্যাম আছে। দু চার প্যাকেট বিক্রি করার এই একটা মৌকা। অন্য সময় শালা বাসগুলো আমাদের জন্য দাঁড়াতেই চায়না। আজ একটু সুবিধা পেয়েছি চটপট কটা গাড়িতে কাজ করে নিই। -কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে তো সব গাড়ি খালি হয়ে যাবে। উপদেশের সুরে বলে রজত।
বাড়তি পয়সা ফেরত দিতে দিতে বাদামওয়ালা জবাব দেয় -ওই জন্যই তো তাড়াহুড়ো করছি। পিছন থেকে আরেক যাত্রীর আহ্বানে বাদামওয়ালা এগিয়ে যায় সেদিকে।
রাস্তার পাশে এক ট্রাফিক কনস্টেবল আখের রস বিক্রেতাদের টুলে বসে খোশগল্প জুড়েছে। তাকে দেখে অসহিষ্ণু যাত্রীদের মন্তব্য -পুলিশগুলো হয়েছে সব। কাজের কিছু নেই। কোথায় একটু এগিয়ে দেখবে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে গেল কেন, তা নয়, আড্ডায় মশগুল হয়ে আছে। দুহাতে ঘুষ নেওয়া আর সাধারণ মানুষের উপর রংবাজি করা ছাড়া এদের কোন কাজ নেই।
আর এক যাত্রী পুলিশের উদ্দেশ্যে ডাক পারেন -ও দাদা পুলিশ, একটু দেখুন কি হলো।
-দেখার কিছু নেই, আমাদের এখন কাজ শেষ। ছুটি হয়ে গেছে।
-ছুটি হয়ে গেছে তো এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন? বাড়ি যান।
-তাই যেতাম। কিন্তু কি করব? ওনারা আবার কখন সড়ক শয্যা ছেড়ে বাড়ি যাবেন তার অপেক্ষায় বসে আছি।
-ওনারা আবার কারা?
-শোনেন নি নাকি? সামনে চার মাথার মোড়ে বিরোধীপক্ষ পেট্রোল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে রাস্তায় শুয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। করুক প্রতিবাদ। সারা দিন - মাস - বছর ভর অবরোধ কর। আমাদের একটু হাড় জুড়োয়। এই গরমে সারাদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক সামলানো যে কি ঝক্কি তা কি কেউ আর বুঝবে?
-তা কাল থেকে কি পেট্রোল-ডিজেলের দাম কমে যাবে এতে?
-আমাকে কেন? ওদের গিয়ে বলুন। তবে এখন নয় খানিক পরে। একটু আরাম তো করতে দিন।
রজত বসে বসে সব দ্যাখে শোনে আর মুচকি হাসে। হঠাৎ হাতের মোবাইলটা বেজে ওঠে। অপরপ্রান্তে দাদার ব্যাকুল কণ্ঠস্বর - কিরে আর কত দূর?
-এইতো বাসে, আসছি।
-সাতটার মধ্যে ফিরতে পারবি তো?
-এখন তো পাঁচটা বাজে, মনে হয় পারবো। তবে রাস্তায় বেশ জ্যাম আছে।
-কোথায় আছিস এখন?
-বাইপাসে, আনোয়ার শাহ কানেক্টর এর কাছে।
-এখনো রুবি পৌছসনি? হাওড়া পৌছবি কটায়? তারপর ট্রেন। তোর তো বাড়ি পৌঁছতেই আটটা পার হয়ে যাবে। -ঠিক সময়েই তো বেরিয়েছিলাম। কি করবো? রাস্তায় যা জ্যাম। এতক্ষণে তো ধর্মতলা পৌঁছে যাবার কথা।
-তোর কোন দায়িত্ব জ্ঞান নেই। বারবার নিষেধ করলাম, মোবাইলটা নিস না। কিন্তু তোর ঐ জেদ। না দিলেই দাদা খারাপ। এখন দেখ তো কি বিপদে পড়লাম। জানতিস আমি আজ দিল্লি যাব অফিসের কাজে। কোথায় একটু সময় হাতে নিয়ে আগে আগে রওনা দিবি। তা নয়, একেবারে প্রোগ্রাম শেষ না করেই বেরোলে হচ্ছিল না। কত দরকারি নম্বর ওতে লোড করা আছে। তাছাড়া বাড়ির সাথে ও তো যোগাযোগ রাখা যাবে না। কি করবো এখন? মহা মুশকিলে পড়লাম তো।
-তুই বেকার ওসব চিন্তা করছিস। দেখ না আমি ঠিক সময়েই পৌঁছে যাব। না হলে তোর ট্রেন ছাড়ার আগে হাওড়া স্টেশনে ও তো দিয়ে দিতে পারবো।
-ঠিক আছে তুই যেমন করে পারিস সময়ে ফেরার চেষ্টা কর। না হলে আমি কিন্তু খুব অসুবিধায় পড়বো।
লাইনটা কেটে যায়। রজত ও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ও নিজে ভাল করেই জানে সময় মতো বাড়ি বা হাওড়া স্টেশন কোথাও পৌঁছতে পারবে না। অবশ্য সত্যি করে বললে পৌঁছতে চায় ও না। কি কুক্ষনেই যে মহুয়াকে মোবাইলটা দেখাতে গেছিল। রজত ই বা কি করে বুঝবে যে মহুয়া ফোনটাই চেয়ে বসবে। সবে মাত্র মেয়েটা রজতের প্রতি একটু নরম হতে শুরু করেছে, এ সময় কি আর সরাসরি দিতে পারব না বলা যায়। তাহলে তো গল্প ওইখানেই শেষ হয়ে যাবে, প্রেস্টিজ বলে আর কিছু থাকবে না। যদিও ফোনটা কালই ও ফেরত দিয়ে দেবে বলেছে, তবুও রিক্সটা রজত একটু বেশিই নিয়ে ফেলেছে। এই হয়েছে মুশকিল। যতদিন না পড়াশুনো শেষ করে একটা চাকরি বাকরি হচ্ছে, ততদিন নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছার কোন মূল্যই নেই। স্বাধীন দেশের পরাধীন নাগরিক। আঠারো হলে স্বাবলম্বী। ভোটের লাইনে দাঁড়াও। মত প্রকাশের স্বাধীনতা পেয়ে গেলে, অথচ একটা নিজের মোবাইল পাওয়ার স্বাধীনতা নেই।
কলেজ সোশ্যালে ওর নাটকের কয়েকটি দৃশ্য ক্যামেরা মোবাইলে তোলার অজুহাতে দাদার থেকে মোবাইলটা নিয়ে গেছিল রজত। অন্যদিন হলে পাওয়ার কোনো চান্সই ছিল না। আজ নেহাত দাদা দিল্লি যাবে বলে অফিস যায় নি। তাই শত অনুরোধের পর চিড়ে ভিজে ছিল।
আসলে কয়েকদিন হল মহুয়া একটা মোবাইল কিনেছে। সাধারণ কমদামি, তবুও মোবাইল তো। রজতের কিছুই নেই। তাই ভাও বাড়াবার জন্য দাদার মোবাইল টাই আজ চেয়েচিন্তে জোগাড় করেছিল। রজত জানতো দাদার দামী ক্যামেরা মোবাইল দেখে মহুয়া ফিদা হবেই হবে। কিন্তু কে জানতো চট করে ফোনটাই আজকের জন্য পাল্টা-পাল্টি করতে চাইবে। উভয় সংকটের মধ্যেও শেষ পর্যন্ত রিক্সটা নিয়েই ফেলেছে রজত। একটা দিন বৈ তো, বেশী তো কিছু নয়।
ভয়ে ভয়ে সরাসরি বাড়িই ফিরছিল রজত। যা হোক কিছু একটা বলে দাদাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করতো। যদিও সে চেষ্টা কতটা সফল হতো তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল তার। বরং দু চার ঘা কপালে জোটার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। তবুও প্রেমের জন্য এটুকু আত্ম বলিদান দিতে প্রস্তুত ছিল সে। বাসটা জ্যামে আটকে যাওয়ায় এক মোক্ষম অজুহাত হাতের কাছেই পেয়ে গেল। অযথা একগাদা মিথ্যা বলা বা সামনা সামনি হওয়ার কোন প্রয়োজন থাকলো না।
-ঝারন চাই, ঝারন, গাড়ী পরিষ্কারের জন্য পালকের ঝারন, লাল নরম কাপড়ের ঝাড়ন-- ছোট বড় গাড়ি ফাঁক গলে একজন হকার বিভিন্ন রকমের ধারণ ফেরী করে বেড়াচ্ছে।
রজতদের বাসের পাশে দাঁড়ানো এক গাড়ি মালিক ঝারন ওয়ালা কে ডাক দেয়
-ও ঝাড়ন ওয়ালা, কত করে দিচ্ছ?
-কোনটা নেবেন? লাল কাপড় 15 টাকা পালকের টা 50 টাকা।
-কাপড়ের টা 10 করে হবে?
-কম হবে না দাদা। আজ স্পেশাল ধামাকা, ফ্রিতে একবার গাড়ি সাফাই।
-সেটা আবার কি?
-দাদা অন্যদিন সিগনালে দাঁড়িয়ে পয়সা নেবার ও সুযোগ পাইনা। তার আগেই বাত্তি সবুজ, পিছনের গাড়ির প্যাঁ প্যাঁ হর্নের তাড়া। ট্রাফিক সার্জেন্ট এর ধমকের চোটে খদ্দের ও গাড়ি নিয়ে কেটে পড়ে। আপনাদের সেবা করার তো সুযোগই পাই না। তাই আজ স্পেশাল ধামাকায় সব খদ্দেরের গাড়ি পরিষ্কার করে দিচ্ছি ফ্রি তে।
-তা, তোমাদের এই ধামাকা আজ কতক্ষণ চলবে?
-যতক্ষণ এখানে আপনারা আটকে থাকবেন।
-বেশ মজা তো। আইডিয়াটার মধ্যে নতুনত্ব আছে। তাহলে দাও একখানি কাপড়ের ঝারন।
ঝারনওয়ালা মাল দিয়ে পয়সা গুনে নিয়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে।
-কি হলো গো? বললে যে ফ্রিতে গাড়ি সাফাই করে দেবে, তা চলে যাচ্ছো যে বড়।
-কাজ শুরু হয়ে গেছে দাদা। পিছনে তাকিয়ে দেখুন। আমাদের যেমন কথা তেমনি কাজ।
-ভদ্রলোক জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখে দুটো বাচ্চা ছেলে সত্যিই গাড়ির ধুলো সাফাইয়ের কাজে লেগে গেছে। নিশ্চিন্ত হয়ে মুচকি হেসে স্বস্তিতে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে বসেন ভদ্রলোক। ছেলে দুটো গাড়ির সামনে পিছনে ঝারন দিয়ে পরিষ্কার করে জানালার সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দাঁড়ায়।
-কি হলো আবার পয়সা চাইছ কেন? বলে গেল ফ্রিতে পরিষ্কারের কথা?
-ফ্রী তেই তো করলাম কাকু। তাবলে দুটো টাকা বকশিস দেবেন না?
-বকশিস! কিছু পাবিনা, যা ভাগ এখান থেকে। শুধু লোক ঠকানোর ধান্দা।
ছেলেদুটো দড়াম করে গাড়িতে এক লাথি মেরে দৌড়ালো সামনের দিকে।
গাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি পেয়ে গেল রজতের। মনে মনে সে ভাবে ব্যবসা তাহলে শুধু সচল গাড়িতে নয়, রাস্তায় জ্যামে দাঁড়ানো অচল গাড়িতেও হয়। ব্যাপারগুলোকে এতদিন এভাবে নজর করেনি তো। ফোনটা আবার বেজে উঠল।
-তোর আসতে আর কতক্ষণ লাগবে?
-রাস্তা অবরোধ তো, যাবো কি করে?
-তার মানে এখনো ওখানেই ঢ্যাড়স এর মতন বসে আছিস। একটা ট্যাক্সি ধরে আসতে পারছিস না?
-তোর ও যেমন বুদ্ধি দাদা! ট্যাক্সির কি ডানা আছে যে উড়ে যাবে? এদিকে তো মেট্রো ও নেই যে মাটি ফুঁড়ে চলে যাবো।
-কি ঝামেলায় পরলাম দেখতো! সাতটা বাজে, এখন তো বাড়ি থেকে না বেরোলে সাড়ে আটটায় আমার ট্রেন ও ধরতে পারবো না। চুপচাপ না বসে থেকে হেঁটে হেঁটেও তো এগোতে পারতিস, তাহলেও এতক্ষনে হাওড়া প্রায় পৌঁছে যেতিস।
-কি করে জানবো বলতো অবরোধ এতক্ষণ চলবে? এই ছাড়বে এই ছাড়বে করে বসেই থেকে গেলাম। আর এতোটা রাস্তা কি পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়?
-তোর আর বাড়ি ফিরে কাজ নেই। ওখানেই বসে থাক। আমি ফিরে আসি, তারপর তোকে বোঝাবো কতটা রাস্তা হাঁটা যায়!
ফোনটা আবারও কেটে যায়। রজত মুচকি হেসে ফোনটা পকেটে ঢোকায়। এ সময় দাদার মুখোমুখি হলে অন্য ব্যাপার ছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ পরে ফিরে এসে দাদার এই তেজ যে আর থাকবেনা রজত তা ভালো করেই জানে।
রজতদের বাসের গা ঘেঁষে বাঁদিকে আরেকটি বাস দাড়িয়ে। ওই বাসটিও প্রায় খালি। অন্য দিকে নজর থাকায় রজত এতক্ষণ খেয়াল করে নি তার মুখোমুখি জানালার ধারে একটা অল্প বয়সী মেয়ে বসে আছে। বয়স তার থেকে কিছু কম হবে। ফোনে কথা বলার সময় মেয়েটি এক দৃষ্টে রজতের দিকে তাকিয়ে ছিল। এখন চোখাচোখি হওয়ায় মেয়েটি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বাসের অন্য যাত্রীদের একটু নিরীক্ষণ করে আবার মেয়েটির দিকে তাকাতেই ফের চোখাচোখি। মেয়েটা আবার নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। কিন্তু মুখে এক চিলতে হাসি যেন ছলকে পড়লো। রজত স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার হৃদপিন্ডের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজের বুকের আওয়াজ যেন সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে। এর মধ্যে আরো একবার দৃষ্টি বিনিময়। ফের হাসি হাসি মুখ অন্যদিকে। রজতের সারা শরীরের রক্তে যেন খুশির স্রোত বইতে শুরু করেছে। কিছু একটা এবার বলা বা করা প্রয়োজন। বাস পালটে কি ও বাসে চলে যাবে? কিন্তু ভাড়াটা যে দেওয়া হয়ে গেছে। ও বাসে উঠলে আবার ভাড়া দিতে হবে। বরং কন্ডাক্টরকে ধরে আগে খানিক পয়সা ফেরত নিয়ে নিলে হয়। পুরোটা পথ তো সে এখনো যায়নি, কিন্তু ভাড়া তো পুরোটাই দিয়েছে।
এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কন্ডাকটারকে খোঁজার চেষ্টা করে রজত। কন্ডাকটার ও অভিজ্ঞ মানুষ। সে জানে কখন বাসে থাকতে হয়, কখন কেটে পড়তে হয়। বাসে থাকলে বহু যাত্রী ভাড়া ফেরত নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে। সুযোগ বুঝে তাই সেও নিরাপদ দুরত্বে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রজত বাস থেকে নামবে কি নামবে না দোটানার মধ্যে সিট থেকে উঠে দাঁড়ায়।
হঠাৎ এ সময় বাইরে দাঁড়ানো সবার মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। পথ অবরোধ উঠে গেছে। যাত্রীদের মধ্যে সিট দখল এর হুড়োহুড়ি। রজতকে অন্য কিছু ভাবার সময় না দিয়ে পাশের বাসটি হুস করে চলে গেল। দু'জোড়া ব্যাকুল চোখের বাসের জানলা দিয়ে পরস্পরকে খোঁজার চেষ্টা ব্যর্থ হলো।
হতাশ রজত আবারও বসে পরলো নিজের সিটে। ওই লোকগুলির কি পারতো না আরো কিছুক্ষণ ওর জন্য অবরোধ চালিয়ে যেতে।

コメント