স্বপ্নপূরণ
- NM84 Members
- Apr 15, 2021
- 9 min read
Updated: Apr 15, 2021
সর্বানী গুহ পাহাড় সবসময় আমাকে ভীষণ টানে। তাই পাহাড়ে যাওয়ার সুযোগ পেলে কখনো হাতছাড়া করিনা। সবাই ট্রেকিং করতে যায় শুনি, সেই শুনে মনে মনে ইচ্ছে অনেকদিন থেকেই ছিল। সেভাবে সুযোগ কোনোদিন আসেনি। একদিন হঠাৎ

করে রিনি এসে বলল “বৌদি, ট্রেকিং করতে যাবে? আমরা সান্দাকফু-ফালুট যাচ্ছি।” রিনি আমার ছোট বোনের মতো। এইভাবে সুযোগ হঠাৎ করে আমার কাছে এসে যাবে সেটা কোনোদিনও কল্পনাও করিনি। ব্যাপারটা আনেকটা মেঘ না চাইতে জলের মতো। সুযোগটা যখন হাতের কাছে পেয়েই গেলাম, হাতছাড়া করতে মন চাইল না। ভয়ে ভয়ে কর্ত্তাকে বলেই ফেল্লাম, “আমি ট্রেকিং যেতে চাই। আমি কি যেতে পারি?” উনি পারমিশনও দিয়ে দিলেন। পারমিশন পেয়ে আমি আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়লাম। মনের মধ্যে একটা আনন্দ আর সঙ্গে ভয়ও কাজ করছিল। শুনেছি পাহাড়ে ট্রেকিং খুব কঠিন, মনে সংশয় হতে লাগল, আমি সত্যিই পারবো তো? যাই হোক, মনে সাহস সঞ্চয় করে প্রস্ততি শুরু করলাম। রিজার্ভেশান করা হল। আমার রুকস্যাক ছিল না। একজনের কাছ থেকে সেটাও একটা জোগাড় হোল। যাবতীয় দরকারি জিনিষপত্র কেনাকাটি করে প্যাকিং শুরু করলাম। ক্রমশ, যাবার দিন যত কাছে আসতে লাগলো, মনে

উত্তেজনাও ঠিক ততটাই বাড়তে লাগলো।
অবশেষে একদিন যাওয়ার দিনও চলে এল। চিত্তরঞ্জন থেকে আমরা ৫ জন একটা টাটা সুমো করে আসানসোল স্টেশন পৌঁছালাম। সেখান থেকে সন্ধ্যে ৭ টা নাগাদ ব্ল্যাক ডাইমণ্ড এক্সপ্রেস ধরে বর্ধমান পৌঁছালাম। বর্ধমান থেকে দার্জিলিং মেল এ আমাদের রিজার্ভেশান করা ছিল। রাতের খাওয়া সেরে আমরা রাত ১১.৩০ এ ট্রেনে উঠলাম। ঐ ট্রেন এ আমাদের গ্রুপ এর আর চারজন সদস্য কলকাতা থেকে আসছিল, পরদিন ভোর ৫.০০ টা নাগাদ নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছালাম। সেখানে আমাদের জন্য গাড়ি রিজার্ভ করা ছিল।
সময়মতগাড়ি চলে এল। আমরা গাড়ির ছাদে আমাদের রুকস্যাক ও বাকি সব প্রয়োজনীয় মালপত্র তুলে গাড়িতে উঠে পড়লাম। জীবনে প্রথমবার একা ঘুরতে যাচ্ছি, মনে ভয় আর তার সাথে একটু উত্তেজনাও ছিল। যাইহোক, খুব আনন্দ করতে করতে দুপুর ২.০০ টো নাগাদ মানেভঞ্জন পৌঁছালাম। মাস্টার-জীর হোটেলে পৌঁছে স্নান খাওয়া সেরে সবাই মিলে কাছেই একটু ঘুরতে বেরোলাম। মানেভঞ্জন একটা ছোট্ট গ্রাম। এত সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখে আমি তো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মাঝে ওখানে একটা এজেন্সিতে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে এন্ট্রি পাস আর গাইড এবং মালবাহক বা পোর্টার বুক করা হল। সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে আমরা শুতে গেলাম, কারণ পরের দিন সকাল সকাল বেরোতে হবে। প্রথমবার পাহাড়ে ট্রেকিংএ এসেছি, অদ্ভূত এক অনুভূতিতে সারারাত ঘুমোতে পারিনি। সবার সাথে তখনও ঠিকমত আলাপ জমে ওঠেনি। যাই হোক, পরদিন ভোরে উঠে জিনিষপত্র গুছিয়ে রেডি হয়ে গেলাম। ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ সময় লাগলো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন দপ্তরের চেক পোস্টে, নাম-ধাম এন্ট্রি করার জন্য, এটা ঐ রুটে ট্রেকিং করতে গেলে আবশ্যিক। তারপর আমাদের পথ চলা শুরু হল। আমাদের সাথে একজন গাইড আর একজন মালবাহক ছিলেন। আমাদের ট্রেকিং রুটটা ছিল মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু-ফালুট হয়ে শ্রীখোলা পর্যন্ত।
আজ ট্রেকিং এর প্রথম দিন। আমাদের আজকের গন্তব্য ছিল মানেভঞ্জন থেকে টংলু, দূরত্ব ১১ কিমি.। প্রথম ৬ কিমি. বেশ চড়াই ছিল, প্রথম প্রথম বেশ কষ্ট হচ্ছিল। সেদিন আবহাওয়া বিশেষ ভাল ছিল না। কিন্তু তার মধ্যেও প্রথমবার ট্রেকিং-এ যাওয়ার একটা আলাদা রোমাঞ্চ ছিল। আমাদের আশেপাশে মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছিল, মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ও পড়ছিল আর তার মধ্যে আমরা এগিয়ে চলেছি। ২ কিমি. হাঁটার পর আমরা চিত্রে পৌঁছালাম। প্রথমদিন বলে, সবাই একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। একটা দোকানে একটু গরম চা খেয়ে, রেস্ট নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। এরপর এল মেঘমা, মেঘে ঢাকা ছোট্ট একটা গ্রাম। মেঘমা ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম। দুপুর ৩.৩০ নাগাদ টংলু পৌঁছালাম। ওখানে আগে থেকে একটা হোমস্টে-তে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা ছিল। সেখানে ওনারা আমাদের জন্য লাঞ্চ তৈরি করেই রেখেছিলেন। বেশ খিদেও পেয়েছিল। হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিয়ে একটু রেস্ট করে সামনে একটু ঘুরতে বেরোলাম। তখন বেলা প্রায় পড়ে এসেছে, সূর্য পশ্চিমাকাশে প্রায় ঢলে পড়েছে। আমরা যেখানে ছিলাম জায়গাটা ভারি সুন্দর। চারিদিকে জঙ্গল, মাঝখানে আমাদের হোম-টা। আশেপাশে আরও দু-একটা বাড়ি ছিল। আমরা ওই জঙ্গলের পথ ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলাম, ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার, দুদিকে জঙ্গল, বেশ গা ছমছমে পরিবেশ। যাই হোক, তাড়াতাড়ি ফিরে এসে চা আর পকোড়া খেয়ে একটু আড্ডা দিয়ে ডিনার সেরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।

আজ দ্বিতীয় দিন। গন্তব্য কালিপোখরি। টংলু থেকে কালিপোখরির দূরত্ব প্রায় ১৩ কিমি.। সকাল ৭ টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। টংলু থেকে গৈরিবাস পৌঁছালাম, মাঝে আন্ত:রাষ্ট্রীয় সীমান্ত পার করে নেপালে প্রবেশ করলাম। টুমলিং নেপালের একটা ছোট্ট গ্রাম, খুব সুন্দর। চারিদিকে রডোডেনড্রন এর গাছ। আমরা যেহেতু অক্টোবর মাসে গিয়েছিলাম, তাই রডোডেনড্রনের ফুল দেখা আমাদের ভাগ্যে জোটেনি। প্রথমবার ট্রেকিং-এ এসেছি, এতটা পথ হেঁটে তাই একটু ক্লান্ত বোধ করছিলাম। গৈরিবাসে পৌছানোর আগে এক জায়গায় সেখানের চেকপোস্টে আমাদের পারমিট দেখাতে হল। গৈরিবাস পৌঁছে একটু বিশ্রাম করে আবার হাঁটা শুরু করলাম। কোথাও চওড়া, কোথাও পাকদণ্ডী, আবার কোথাও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলা। এইভাবে চলতে চলতে বিকেল ৫.১৫ টা নাগাদ কালিপোখরি পৌঁছালাম। এখানেও আমাদের জন্য হোমস্টে বুক করা ছিল। কালিপোখরি হল সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানের অন্তর্গত একটা জনমানবহীন ছোট্ট গ্রাম। এখানে কালো জলের ছোট্টো একটা জলাশয় আছে। নেপালি ভাষায় পুকুর কে পোখরি বলে, তাই এই জায়গাটার নাম কালিপোখরি। এই পুকুর বৌদ্ধদের পবিত্র স্থান। এখান থেকে সান্দাকফু নজরে পড়ে। সারাদিন অতটা হেঁটে সবাই ক্লান্ত ছিলাম, তাই তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম। তবে পাহাড়ের আবহাওয়াতে একটা অদ্ভূত ম্যাজিক আছে, সারা দিনের ক্লান্তি এবং পা যন্ত্রণা এক রাতের মধ্যে ঠিক হয়ে সকালে আবার সতেজ হয়ে যেতাম। আজ তৃতীয় দিন। আগেই বলেছি কালিপোখরি জায়গাটা খুবই সুন্দর। তাই সকালে উঠে আশপাশটা একটু ঘুরে নিলাম। তারপর ব্রাশ করে চা-টিফিন খেয়ে জিনিষপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পরের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। আজ যাব সান্দাকফু, ৭ কিমি. হাঁটা। সান্দাকফু সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১১,৯৩০ ফুট উচ্চতায় পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ স্থান। ভারত-নেপালের সীমানায় অবস্থিত। রাস্তাটা ৭.০ কিলোমিটার ঠিকই, কিন্তু কোথাও চড়াই, কোথাও উৎরাই, কোথাও আবার বন্ধুর। কঠিন ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যেও একটা ভাললাগা মিশে ছিল। প্রায় অর্ধেক রাস্তা পার করার পর পৌঁছালাম বিকেভঞ্জনে। ওখানে মোমো আর কফি সহযোগে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার এগিয়ে চললাম। রাস্তায় আরও একটা গ্রুপের সাথে দেখা হল, তাদের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ছবি তুলে এগোলাম। দুপুর ২.৩০ নাগাদ সান্দাকফুতে পা রাখলাম। এখান থেকে হিমালয়ান রেঞ্জের এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে, মাকালু (এগুলো পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গের মধ্যে অন্যতম) পরিস্কার দেখা যায়। ওখানে আমাদের এক বন্ধু ইন্সপেকশান বাংলোতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেদিন সকলেই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ওখানে পৌঁছে দুপুরে গরম-গরম ভাত-ডাল আলুভাজা আর ডিমভাজা দিয়ে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিলাম।

সান্দাকফুতে দিনের বেলা তাপমাত্রা ছিল ৮ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর রাতে ছিল -৫ থেকে -১ ডিগ্রী, সঙ্গে ছিল হাড় কাঁপানি ঠাণ্ডা হাওয়া। এটা সান্দাকফুর একটা বিশেষত্ব। তাই সন্ধ্যায় চা খেয়ে ঘরে বসেই আড্ডা হল ফায়ার প্লেস এর সামনে। রাতের মেনুতে ছিল খিচুড়ি। অনেকদিন পর খিচুড়ি, ডিম ভাজা, আলু ভাজা পেয়ে যে কি আনন্দ হল, বলে বোঝানো যাবে না! খাবার খেয়ে ঘুমোতে গেলাম, রেস্ট নিতে হবে কারণ পরের দিনের হাঁটাটা ছিল সবচেয়ে লম্বা। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়লাম সূর্যোদয় দেখার জন্য। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ছিল, গরম জামা কাপড়ে মুড়ে ডি.আই বাংলোর ছাদ থেকে সানরাইস দেখতে গেলাম। থরেথরে জমাট বাঁধা মেঘের উপরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙঘা। কাঞ্চনজঙঘা পর্বত সৃঙ্গের উপর সূর্যোদয়ের অপরূপ দৃশ্য দুচোখ মেলে দেখলাম। এরকম সূর্যোদয় দেখতে পেয়ে নিজেকে সত্যিকারের ভাগ্যবতী মনে হতে লাগল। ফিরে এসে আবার তৈরী হয়ে নিলাম পরের গন্তব্যের জন্য।

আজ ট্রেকের চতুর্থ দিন। যাব সান্দাকফু থেকে ফালুট ২১ কিমি.। ফালুটের উচ্চতা ১১,৮০০ ফুট। যাওয়ার আগে শুনেছিলাম যে ট্রেকিং-এর এই রাস্তাটা সবচেয়ে দীর্ঘ আর সবচেয়ে সুন্দর। তাই মনে একটু কৌতূহল নিয়েই যাত্রা শুরু করলাম। প্রকৃতির সৃষ্ট নৈসর্গিক ভাস্কর্যের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে ও সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা এগিয়ে চললাম। আমাদের ভাগ্য খুব ভাল ছিল, রোদ ঝলমলে আকাশ, চারিদিকে উঁচু উঁচু পাহাড় যেন সবুজ চাদরে মোড়া, অনেক সিলভার ফার গাছের মধ্যে দিয়ে ঘাসের উপর দিয়ে অপরূপ সুন্দর সব দৃশ্য দেখতে দেখতে চলতে থাকলাম। সবুজ ঘাসের উপত্যকার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে ছন্দু গ্রামে পৌঁছালাম। পথে এক বন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়ে। গরম চা আর ম্যাগি খেতে খেতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা ফালুট গামি গাড়িতে করে ওকে সবরগ্রাম পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হল। এরপর আমরা আবার ফালুটের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম। পুরো রাস্তাটাই যেন কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের কে নজরে রাখল। এই রাস্তায় চলাকালীন এভারেস্ট-এর পাহাড় চূড়াও চোখে পড়ল। কাঞ্চনজঙ্ঘার পর্বতমালাকে সামনে রেখেই হাঁটতে হাঁটতে বিকেল প্রায় ৩.৩০ নাগাদ আমরা পৌঁছালাম সবরগ্রাম। ডিমসিদ্ধ আর ম্যাগি তখন অমৃতসম, দ্বিপ্রাহরিক আহার এই দিয়েই সারলাম। পথে আমিও পায়ে চোট পেয়েছিলাম। তাই হাঁটার গতি কমে গিয়েছিল। আমাদের গ্রুপের এক ভাইয়ের সাহায্যে সেদিনের যাত্রা শেষ করতে পেরেছিলাম। তাই ফালুট পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যে ৬.০০ টা বেজে গিয়েছিল। রাস্তায় ছোট ছোট বোল্ডার থাকায়, অন্ধকারে হাঁটতে বেশ অসুবিধা হয়েছিল। এখানে গোর্খাল্যাণ্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পরিচালিত ট্রেকার্স হাট বুক করা হয়েছিল। পৌঁছে দেখলাম বন্ধুর অবস্থা খানিকটা ভাল। গাড়ি ওকে সবরগ্রাম অবধি পৌঁছে দেয়। তারপর ৭.০ কিমি. আরও পেরিয়ে সে পৌঁছায়। সেদিন এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে ওখানে পৌঁছে রাত্রি ৮.১৫-র মধ্যে ডিনার সেরে শুয়ে পড়েছিলাম। পরের দিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় ভিউ পয়েন্ট এ গেলাম। ওখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং আরও অনেক শৃঙ্গ যাদের নিয়ে “স্লীপিং বুদ্ধ” পরিবার, বেশিরভাগেরই উচ্চতা ৮০০০ মিটারের ওপরে, পরিস্কার একদম সামনে থেকে দেখা যায়। মনে হয় যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। ধীরে ধীরে সূর্য মেঘের কোল ছেড়ে উপরে উঠতে লাগলো, ক্রমশ: সূর্যের আলোয় বরফাবৃত পাহাড়চূড়াগুলো সোনার বরন ধারণ করল। সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য, চোখে না দেখলে অনুভব করা যায় না। লিখে কিছুতেই সে অনুভুতি বোঝাতে পারব না। গোটা আকাশ জুড়ে যেন রঙের খেলা। তবে এতটাই ঠাণ্ডা হাওয়ার প্রকোপ ছিল যে খালি হাতে ছবি তোলাও যাচ্ছিল না, হাত কেটে পড়ার জোগাড়। তার মধ্যেও কষ্ট করে কিছু ছবি ও ভিডিও করে নীচে নেমে এলাম। তারপর টিফিন আর প্যাকিং সেরে বেড়িয়ে পড়ার জন্য তৈরী হলাম।

আজ পঞ্চমদিন। আমাদের গন্তব্য ১৬.০ কিমি. দূরত্বে গোর্খে। আমরা সিঙ্গালীলা ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। প্রথমে একটা আর্মি ক্যাম্প পার করেই শুরু হল নীচের দিকে নামা। চারিদিকে পাইন, রডোডেনড্রন ও বাঁশ গাছের ঘন জঙ্গল। যতই বনের মধ্যে ঢুকতে শুরু করলাম, মনের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হতে থাকলো। জঙ্গলের নিস্তব্ধতা ক্রমেই গ্রাস করতে থাকলো। শুরু থেকেই একটা ঝর্নার শব্দ ভেসে আসছিল, কিন্তু জঙ্গল এতটাই ঘন ও গভীর যে সেটা চোখের অগোচরেই রয়ে গেল। কোথাও কোথাও পাহাড়ের খাঁজ থেকে নেমে এসেছে ছোট ছোট জলের ধারা। কোথাও বা সেগুলো একত্রিত হয়ে বেশ খরস্রোতা ধারার আকার ধারণ করেছে। জঙ্গলের ভেতরটা বেশ স্যাঁতস্যাঁতে। কোথাও কোথাও বড় বড় পাইন গাছ, দেওদার গাছ ভেঙ্গে পড়ে রয়েছে রাস্তা জুড়ে, সেগুলোকে কখনো পাশ কাটিয়ে, কখনো নীচে দিয়ে অতি সন্তর্পণে পার হতে হয়েছিল। বাঁশ পাতার শিরশির শব্দে ও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে একটা রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। আবার কোথাও বা পাহাড়ের খাঁজ থেকে নেমে আসা জলধারার জন্য রাস্তাগুলো বেশ কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল, একটু অসাবধান হলেই পাহাড়ের ঢালে কয়েকশ’ ফুট নীচে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আবার কোথাও যেন মনে হচ্ছিল ঝরা পাতা বিছানো কার্পেটের রাস্তা। গাইডের মুখে শুনেছিলাম যে এই জঙ্গলে প্যান্থার আর রেড পাণ্ডা ছাড়াও আরও অনেক হিংস্র পশুর বসবাস। আমরা অক্টোবর মাসের শেষের দিকে গিয়েছিলাম বলে তাদের দেখা মেলেনি, কারণ শীতকালে তাদের দেখা পাওয়া যায় না। তবুও কেমন যেন একটা গা ছম-ছম করা অনুভুতি। তাই আমরা সবাই একসাথে চলছিলাম। দলছুট হওয়া মানেই সমূহ বিপদ। আমাদের পুরো ট্রেক এর মধ্যে আমার কাছে এই রাস্তাটা ছিল সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। শেষের দিকে প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ ভীষণ উৎরাই ছিল, এক একবার পা হড়কে ২-৩ ফুট নীচে নেমে যাচ্ছিলাম। যাই হোক, এইসব অতিক্রম করে দুপুর ২.৩০ নাগাদ গোর্খে পৌঁছালাম। এটা হিমালয়ের কোলে ছোট্ট একটা গ্রাম। গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট্ট নদী, গোর্খেখোলা। ওখানে জি.টি.এর ট্রেকার্স হাট বুক করা হয়েছিল। অল্পস্বল্প কিছু খেয়ে আমরা গ্রামটা একটু ঘুরে দেখতে বেরোলাম। পশ্চিমবাংলা ও সিকিম সীমান্তে খুব সুন্দর এই গ্রামটা। এতদিন নিরামিষ ও নুডলস-ই জুটছিল, এখানে এসে চিকেনের দেখা পেলাম।

সন্ধ্যায় বেশ জমিয়ে চা, চিকেন পকোড়া ও কফি দিয়ে টিফিন সারলাম। রাতে সেদিন ছিল চিকেন কারি ও রুটি। সেদিন আরও একটা মজা হয়েছিল। রাত্রি ১২.০০ টার সময় কেক কেটে আমাদের এক বন্ধুর জন্মদিন পালন করা হয়েছিল। শুয়ে শুয়ে ট্রেকার্স হাটের ছাদে কাঁচের স্কাইলাইট দিয়ে চাঁদনী রাত আর তারাদের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তার আর খেয়াল ছিল না। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আবার একটু আশপাশটা ঘুরে এসে ব্রেকফাস্ট সেরে রেডি হলাম বেরোনোর জন্য।

আজ আমাদের ট্রেকিং-এর শেষ দিন। প্রায় ৬৭ কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছি গত ৫ দিনে। আজ আমাদের গন্তব্য শ্রীখোলা বা সিরিখোলা। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে চারপাশটা পরিদর্শনে বেড়িয়ে পড়লাম। তারপর চা জলখাবার খেয়ে ট্রেকার্স হাটের পরিচালকদের ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আজ হাঁটতে হবে ১২.০ কিমি.। প্রায় ২.০ কিমি. হাঁটার পর সামানদিন নামে একটা ছোট্ট সুন্দর গ্রামকে পাশে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম। মনে মনে ভাবলাম যে এখানেও যদি একদিন থাকা যেত, তাহলে মন্দ হত না। সামানদিন পার করার সময় একটা বাংলাদেশের ট্রেকদল আমাদের পার করে হন্হন্ করে চলে গেল। এবার রাস্তা ক্রমশ নিম্নগামী হতে লাগলো। আমরা চলতে শুরু করলাম পাইন বনের মধ্যে দিয়ে। ঘন জঙ্গল ও পাহাড়ি ঝোড়া পেরিয়ে হাঁটতে থাকলাম। চারিদিকে নানারকম পাখির বিচিত্র আওয়াজ, তার মধ্যে কোনটা পরিচিত কোনটা আবার অপরিচিত। এইধরনের পাখির আওয়াজ একমাত্র পাহাড়েই শোনা যায়। এই জঙ্গলটা ভারী বৈচিত্র্যময়। পাহাড়ি এই পথ খুব সুন্দর এবং বন্ধুর ঠিকই, তার সাথে কষ্টও থাকে অনেক। একটা বড় ঝর্না নদী হয়ে বয়ে চলেছে। আমরা সেই নদীর ওপরের ছোট্ট ব্রীজ পার করে হাঁটতে থাকলাম। প্রথমদিকে যে একটা চাপা উৎকণ্ঠা ও ভয় ছিল, সেটা এতদিনে অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছি। আজ এই ট্রেকিং-এর শেষ দিন, তাই সবার মধ্যে একটা গা ছাড়া ভাব। এইভাবে চলতে চলতে আমরা সিকিম-বাংলা সীমান্তবর্তী রাম্মাম গ্রামে পোঁছালাম। ঘড়ির কাঁটা সময় বলছে ১ টা বেজে ১০ মিনিট। ওখানে একটু রেস্ট নিয়ে টুকটাক খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম শ্রীখোলার উদ্দেশ্যে। এবার ধীরে ধীরে জঙ্গলের পথ শেষ করে গ্রামের পথ ধরে হাঁটা। খুব ক্ষীণ জলস্রোতের শব্দ কানে আস্তে লাগলো। বুঝলাম এখান থেকে শ্রীখোলা বেশি দূরে নয়। যত এগোতে লাগলাম জলস্রোতের শব্দ ততটাই তীব্র হতে লাগলো। অবশেষে বিকেল ৩.৩০ নাগাদ আমরা পৌঁছালাম শ্রীখোলা। ওখানে একজন বাঙালির হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। শেষ দিন, তাই আনন্দের একটা মুহূর্তকেও কেউ হাতছাড়া করতে চাইছিল না। হোটেলে জিনিসপত্র রেখেই সবাই মিলে ব্রীজ পার করে চললাম নদীতে। নদীর পাড় ধরে হাঁটলাম, নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকলাম, যদিও জল ছিল খুব ঠাণ্ডা। নদীর পাড়ে পাথরের ওপর বসে গল্প করলাম, ছবি তুললাম। আসলে আমরা পুরো আনন্দটাকে শুষে নিতে চাইছিলাম। কারণ পরের দিনই তো ঘরে ফেরার পালা। এই ক’টা আনন্দের দিন প্রায় শেষ হয়ে গেল, তাই সবার মন অল্প হলেও ভারাক্রান্ত ছিল। এখানে ঠাণ্ডা অনেকটাই কম ছিল বলে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইরে ঘুরে হোটেলে ফিরে এসে চিকেন পকোড়া আর কফি সহযোগে জমিয়ে আড্ডা দিলাম। আজ আর কারো ঘুমানোর তাগিদ নেই, কেননা পরের দিন তো বাড়ি ফেরা। ডিনার করে বেশ রাত অবধি গল্পগুজব করে ঘুমাতে গেলাম।
সকালে সময় মত গাড়ি চলে এল। জিনিসপত্র প্যাক করে গাড়িতে তুলে আমরাও গাড়িতে উঠে বসলাম। মনের মধ্যে একদিকে যেমন বাড়ি ফেরার আনন্দ, অন্যদিকে পাহাড় ছেড়ে যাবার কষ্ট, দুয়ের মধ্যে টানাপোড়েন চলছিল। পথে মিরিকের রাস্তায় গোপাল ধারা টি-এস্টেট, সৌরীণি টি-এস্টেট ঘুরে, পশুপতি মার্কেটে টুকটাক মার্কেটিং করে শিলিগুড়ি এসে উপস্থিত হলাম। রাতের খাওয়া সেরে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ফেরার ট্রেনে চেপে বসলাম। যথাসময়ে ট্রেন ছেড়ে দিল, চললাম বাড়ি। ট্রেনে বসেই সবাই মিলে পরের ট্রেকিং-এর প্ল্যান করতে লাগলাম। আমার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হল আর আমি একটা অবিস্মরনীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এলাম, যা সারা জীবনের সঞ্চয় হয়ে রইল।

সর্বানী গুহ, অতনু গুহ র সহধর্মিনী
Comments