অনলাইন ক্লাস (স্বাগতা বড়ুয়া)
- NM84 Members
- Oct 1, 2022
- 3 min read
করোনা মহামারীর দুঃসহ স্মৃতি যেমন আমার মনকে নাড়া দেয়, সে রকম কিছু মনোরঞ্জনের স্মৃতিও রয়েছে আমার ঝুলিতে।
করোনার দৌলতে অনেক নতুন নতুন ইংরেজি শব্দ শিখতে পেরেছি। যেমন কোয়ারেন্টাইন, প্যান্ডেমিক, লকডাউন আরো অনেক শব্দ-
আগে শুধু লক-আপ শুনেছিলাম, কোভিডের পর জানলাম লকডাউন বলে একটা শব্দ আছে। তাতে সবাই ঘরবন্দী।
যাইহোক, আসল কথায় আসি। কোভিড পরিস্থিতিতে সরকার ঘোষনা করলেন, অনলাইন ক্লাস হবে।
যেভাবে শিক্ষা, শিল্প, অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছিল,অনলাইন ক্লাস চালু করাতে তবুও একটু আলোর রশ্মি দেখা যাবে, এটা আশা করা গেল।
যে মোবাইল একসময়ে স্কুলে নিয়ে যাওয়া একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল, এখন সেই প্রযুক্তিকেই কাজে লাগিয়ে শিক্ষার অগ্রগতির হিসেব কষা হল।
এবছর যে বাচ্চারা ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছে, পাশের বাড়ির ছোট্ট সিমি তাদের মধ্যে একজন।
সে ভর্তি হয়েছে এই শহরের বিখ্যাত কনভেন্ট স্কুলে। করোনার জন্য ঘরে বসে অনলাইন ক্লাসই এখন ভরসা। বাচ্চা তো কিছু বোঝেনা, তাকে তৈরি করছে তার মা।
সিমির মা অবশ্য বাংলা মিডিয়ামে পড়া খুব মাঝারি মানের ছাত্রী ছিল। সেই জন্যই মেয়ের উপর প্রত্যাশার চাপ খুব বেশি। যেভাবেই হোক কনভেন্ট শিক্ষিতা করে, তাকে গড়ে তুলতেই হবে। চাবুকের মতো তৈরি করবে সে মেয়েকে। ফড়ফড় করে ইংলিশে কথা বলবে তার মেয়ে। তবেই না সবার সাথে টেক্কা দিতে পারবে।
যাইহোক, অনলাইন ক্লাসের প্রথম দিন সিমি কে নিয়ে তার মা কোয়েল বসেছে নতুন কিনে আনা সাদা ধবধবে বিছানার চাদর পেতে। ক্লাস শুরু হওয়ার বেশ কয়েকদিন আগে থেকে সিমিকে গ্রুমিং করা হয়েছে। কিভাবে কথা বলবে, না বলবে সব শিখিয়েছে। অবশ্য তার আগে বছরখানেক সিমির মা কোয়েল নিজে ইংলিশ টিচার ঘরে রেখে স্পোকেন ইংলিশের ক্লাস করেছে।
মেয়েকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে সিস্টার যা জিজ্ঞেস করবে সব উত্তর যেন সে ইংলিশে দেয়। বাংলা যেন একেবারেই না বলে। মেয়েও ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বলেছে। মেয়ে কি বুঝেছে জানি না।
ক্লাসের দিন পরিপাটি করে মেয়ের চুল আঁচড়ে স্কুল ড্রেস পরিয়ে বিছানার উপর ল্যাপটপ খুলে বসেছে। তার আগে স্কুল ড্রেস পড়াতে গিয়ে দেখল দোকানদার ড্রেসটা দিয়েছে দু'সাইজ বড়। একটু পরেই ক্লাস শুরু হবে, আর চেঞ্জ করার সময়ও নেই। স্কার্টটা হাঁটু থেকে বেশ খানিকটা নীচে ঝুলছে। ওটা তবু দেখা যাবে না কিন্তু শার্ট টা বেশ ঢিলা হওয়ার জন্য খুব মুশকিলে পড়লো কোয়েল। ক্লাসও শুরু হওয়ার সময় হয়ে এসেছে। কোনও উপায় না দেখে দোকানদারের চোদ্দগুষ্টির পিন্ডি চটকাতে চটকাতে মেয়েকে ঘুরিয়ে শার্ট টার পেছনে বেশকিছু সেফটিপিন আর মাথার ক্ল্যাচার ক্লিপ দিয়ে আটকে সামনে দিকটা কোনরকমে ঠিকঠাক করে দিল।
ওই অনেকটা ঠাকুরকে শাড়ি পরানোর মতো। সামনের দিকে সব ঠিক লাগে, অথচ পেছনদিকে ঠাকুরের চুল থাকে না, শাড়ি থাকে না, ঐরকম আর কি-
বসানোর আগে মেয়েকে বারবার করে সবকিছু শিখিয়ে দিয়েছে। যথারীতি ক্লাস শুরু হওয়ার আগে মাইক্রোফোন অন করে নিজে ক্যামেরার পেছনে বসেছে যাতে মেয়েকে ইন্সট্রাকশন দিতে পারে। অনেকটা সিনেমার ডিরেক্টরের মতো-
সাড়ে সাতটার সময় সিস্টার এসে সব স্টুডেন্টদের গুড মর্নিং বললেন। সাথে সাথে ফিস ফাস মায়েদের গলা শোনা যেতে লাগল। বাংলা, হিন্দি, তামিল, তেলেগু, ওড়িয়া, পাঞ্জাবী যে যার নিজের ভাষায় বাচ্চাকে গুড মর্নিং বলতে বলছে।
সিস্টার বুঝতে পারলেন, মায়েদের ইন্সট্রাকশন চলছে। একটু মুচকি হেসে সিস্টার বাচ্চাদের সাথে টুকটাক কথা বলা শুরু করলেন। এর মধ্যেই কোন কোন বাচ্চা হাত চুলকাচ্ছে, পা চুলকাচ্ছে, হাই তুলছে, মাথা চুলকাচ্ছে, কেউ কেউ আবার বিছানায় শুয়ে পড়তে যাচ্ছে- ওদিক থেকে কড়া ধমক শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যেই জোরালো গলায় শোনা গেল - "এ খুশী, উঠকাড় বৈঠ, মারেঙ্গে এক ঝাপ্পড়।"
চড়টা ছাত্রীর গালে পড়লো না সিস্টারের গালে পড়লো বোঝা গেল না।
সবার সাথে একটু একটু করে গল্প শুরু করলেন সিস্টার। ওয়ান বাই ওয়ান সবার সাথেই আলাপ করছেন।
সিমির কাছে আসতেই, সিমিকে ঝরঝরে বাংলায় সিস্টার জিজ্ঞেস করলেন, বাড়িতে তোমার সাথে আর কে কে থাকেন? কিছুক্ষণ থেমে সিমি বললো, অর্নব চৌধুরী মাই ড্যাড, কোয়েল চৌধুরী মাই মম্, তারপরেই উপরে নীচে এদিক-ওদিক তাকিয়ে হটাৎ বলে বসল, অ্যান্ড ঠাকুমা চৌধুরী, দাদু চৌধুরী।
সিস্টার বেশ জোরেই হেসে ফেললেন। ভালো করেই বুঝতে পারলেন, ঠাকুমা আর দাদুর নামের প্রয়োজন স্কুলে পড়বেনা বলে ওটা শেখানো হয় নি।
হঠাৎ পিঠে একটা গুম করে কিলের আওয়াজ পাওয়া গেল। তারপরেই জোরালো কান্নার আওয়াজ- সিস্টার খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি বাচ্চাদের সাথে যখন কমিউনিকেট করব, গার্জিয়ানরা প্লিজ তখন কথা বলবেন না বা বাচ্চাদের বকাঝকা করবেন না।
এর মধ্যেই রাস্তা দিয়ে হরেক মাল 'একশো টাকা' বলতে বলতে হকার হেঁকে যেতে লাগল। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য, রেকর্ড করা ভয়েসে শোনা গেল- "এই যে দিদিভাই দাদাভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছেন, কাছে এসে জিনিসগুলো দেখুন, দেখতে কোন পয়সা লাগবে না। ভালো লাগলে তবেই কিনবেন। দাম মাত্র একশো টাকা। বালতি, টুল, হাড়ি, কড়াই যা নেবেন সব একশো টাকা-"
জানলার দিকে পেছন ফিরল সিমি। শার্টের পেছনে লাগানো সব সেফটিপিন মায়ের ক্ল্যাচার ক্লিপ ভিডিওতে দৃশ্যমান হলো। সিস্টার সেই দেখে মুখ টিপে একটু হাসলেন।
আবার শোনা গেল কোয়েলের গলা- সামনের দিকে ঘোর।
ঘন্টা দুয়েক নাটকের নানা পট পরিবর্তনের পর সেদিনের অনলাইন ক্লাস শেষ হল। রোজ এভাবেই চলতে লাগল প্রাথমিক শিক্ষার এক নতুন ধাপ।
স্কুলের চক নেই, ডাস্টার নেই, ব্ল্যাকবোর্ড নেই, সরাসরি কোন বন্ধুর সাথে দেখা সাক্ষাৎ নেই, ডেস্ক নেই, বেঞ্চ নেই, সিস্টারের মুখোমুখি হওয়া নেই, বকুনি খাওয়া নেই- নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে বেডে বসে শুধু অনলাইন ক্লাস।
প্রায় তিনমাস ক্লাস করার পর মা-মেয়ে দুজনেই হাঁপিয়ে উঠল।
এর মধ্যে একদিন সিমির মামা মামিরা ওদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। মামা আদর করে ভাগ্নীকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন- স্কুলে ভর্তি হয়েছো সিমি? কোন স্কুলে পড়ো?
সিমি আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলল- শুধু আমি একা না। মা ও ভর্তি হয়েছে আমার অনলাইন স্কুলে।
সিমির নিষ্পাপ কথা শুনে একসাথে সবাই হো হো করে হেসে উঠল- কেবল সিমির মা কোয়েল ছাড়া।

Comments