top of page

আমার চোখে বালি

সুমনা মুখার্জী

ইন্দোনেশিয়ার বালিতে এসে পৌঁছেছি ঘন্টাখানেক হলো। আকাশপথে চাঙ্গি বিমানবন্দর হয়ে ডেনপাসার বিমানবন্দরে নামতে হবে। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এবং উন্নত বিমানবন্দর হল এই চাঙ্গি বিমানবন্দর। সুসজ্জিত এবং প্রযুক্তিগত ভাবে অত্যন্ত উন্নতমানের ব্যাবস্থা সেখানে। স্কাই ট্রেনে করে এক টারমিনাল থেকে অন্য টারমিনালে দু চার মিনিটেই পৌঁছে যাচ্ছে যাত্রীরা। সমস্ত নির্দেশ এবং নিয়ন্ত্রন কমপিউটারে, যান্ত্রিক মনে হলেও ব্যবস্থাপনায় যে অত্যন্ত সুদক্ষ তা বেশ টের পেলাম। টিকিট পরীক্ষাও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে স্ক্যান করে, দিকনির্দেশনাও সেই দিয়েছিল। সেইমত আমরা সেই টারমিনালে স্কাই ট্রেন এর সাহায্যে পৌঁছে গেলাম। স্কাই ট্রেন অনেকটা আমাদের মেট্রো ট্রেন এরই মতো তবে অনেক উন্নতমানের। নির্ধারিত টার্মিনাল থেকে ডেনপাসার যাবার যাত্রা শুরু করতে হবে।

ঘন্টাখানেক উড়বার পর নামলাম ডেনপাসার বিমানবন্দরে। সেখানে বালিসুন্দরীরা ফুলের মালা পরিয়ে অভ্যর্থনা জানালো। বেশ লাগলো ওদের এই মিষ্টি অভ্যর্থনা। ট্যুরিস্ট বাস আসতেই ট্যুর গাইডের অধীনস্থ হলাম আমরা। বাস ছুটলো বালি কুটা রিসর্ট এর দিকে।

দ্বিপ্রাহরিক ভোজন সারলাম বাসেতেই লোকাল খাবারদাবার খেয়ে। তারপর রিসর্ট এ ঢুকে নরম তুলতুলে বিছানায় দিলাম গা এলিয়ে। চারিদিকে মঙ্গোলিয়ান চেহারার লোকজন, ভিন্নরকম সাজপোষাক ভিন্ন জায়গা। একটু ধাতস্থ হতেই বেরিয়ে পড়লাম রাজপথে। হ্যাঁ হোটেলের সামনেই আলো ঝলমলে পর্যটকদের চোখ ধাঁধানো বালির রাজপথ। চোখ যে সত্যিই ধাঁধিয়ে গেছে টের পেলাম হোঁচট খাবার পর। এক সুদর্শনা সুবেশা বিদেশী তরুণী অযাচিত ভাবে আমাদের সাথে পরিচয় করতে এগিয়ে এলো। সুদর্শনা কন্যাটির সাথে ভদ্রলোক অবশ্য বেশ বেমানান। পরিচয় করার পরেই একথা সেকথার পর এদেশের ডলার নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করতে লাগলো।

মার্কিন ডলার ও বালির ডলার এর বিনিময় নিয়ে আমরাও যে খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিলাম তা নয়, তাই বিষয়টা নিয়ে ঔৎসুক্যও ছিলো। আলোচনার খাতিরে ক্ষণিকের জন্যে পার্স খুলে দুই একবার ডলার বার করে পরীক্ষাও করে ফেললাম। কিন্তু ক্ষণিকের ভুল যে কাল হয়ে দাঁড়াবে তখন কে তা জানত? প্রায় মিনিট দুয়েকের মধ্যেই হাত সাফাই করে নিল ঐ ভিনদেশী দম্পতি। প্রথম দিনেই চোট হয়ে গেলো ১০০ ডলারের তিনটি নোট। চোখের নিমেষে কখন যে তুলে নিয়েছে আমরা বুঝতেও পারিনি। পি সি সরকারের ম্যাজিক দেখেছি কিন্তু এভাবে প্রকাশ্য রাজপথে পার্স থেকে নোটের উধাও হয়ে যেতে প্রথম দেখলাম। একটা কিছু গন্ডগোল হচ্ছে ভেবে হোটেলে ফিরে পার্স বের করতেই পড়ল মাথায় হাত। বেছে বেছে ১০০ ডলারের তিনটি নোট কি সন্তর্পণে আত্মসাৎ করেছে এই পরদেশী দম্পতি। চোখে সত্যিই কি বালি দিয়ে গেলো?

যাই হোক বিষন্নতা দিয়েই শুরু হল বালি ভ্রমণ। অবশ্যই শঙ্কা আর সতর্কতা আরও দৃঢ় হল। পরের দিন ছিল স্থানীয় দর্শনীয় স্থান গুলি দেখা শোনা। পর্যটন ওদের মূলধন, তাই শহরের আনাচে কানাচে স্থাপত্যের নিদর্শন। সেই স্থাপত্যে হিন্দুত্বের ছোঁওয়া। অর্জুনের রথ যেমন আছে, মহাভারতের গল্পও ঠাঁই পেয়েছে এখানে। দেনপাসার এর হস্তশিল্প, বাটিক শিল্প, সুতী শিল্প ঘুরে দেখলাম। এরপর আমরা ছুটলাম (অবশ্যই বাসে করে) একটু পার্বত্য অঞ্চলে মানে পাহাড়ের দিকে। ধানের ক্ষেত, কমলালেবুর গাছ, বৌদ্ধ প্যাগোডার স্টাইলে তৈরী মন্দির এইসব দেখতে দেখতে পৌঁছালাম বাটুর লেক। পাহাড়ের মাঝখানে উপত্যকায় তৈরী লেক বা জলাশয়। পাহাড়ের উপরে তৈরী রেস্টুরেণ্ট এ খেতে খেতে ঐ লেকের শোভা - আহা! আজও ভুলিনি!

রাস্তার দুধারে বিকোচ্ছে মিষ্টি কমলালেবু, গাছে ফলে রয়েছে কমলা, ধাপে ধাপে চাষ হচ্ছে ধান বা অন্য শস্য, যেন I Love Bally বলতে বাধ্য করছে।

এর পরের গন্তব্য ছিল পৃথিবী বিখ্যাত কফি উৎপাদন ক্ষেত্র। লুয়াক কফি। Luwak, এক জাতের বন্য প্রানীর মাধ্যমে জোগাড় করা কফি বীজ থেকে তৈরী হয় এই কফি। প্রক্রিয়াটি যদিও তেমন শ্রুতিমধুর নয় তবে এর উপকারী দিকটি শুনেছি লোভনীয়। তাই কফি প্রেমীরা এটিকে দূর্মূল্য কফি বলেই জানেন। যাইহোক সেই কফির স্বাদ গ্রহণের পর জায়গাটি ঘুরে দেখলাম এবং সেদিনের মত ফিরে এলাম রিসোর্ট এর বিশ্রামকক্ষে।

পরের দিন ছিল বালি সমুদ্রের উপর সময় কাটানোর অবসর। স্পীডবোটে করে কচ্ছপ দ্বীপ (Tortosian Island) ভ্রমণ, প্রবাল দেখা, এবং নুসা দুয়া সমুদ্রতট দেখা। যা ছিল বহু প্রতিক্ষিত এক গন্তব্য। সমুদ্রের নীলিমায় হারিয়ে যেতে গেলে যেতেই হবে নুসা দুয়া তে। প্রকৃতি তার নীল রঙের বৈচিত্রে রাঙিয়ে দিয়েছে সমুদ্র কন্যাকে। ভাষায় বোঝানো কঠিন কি যে সেই সৌন্দর্য! নীলপরী মাথায় সোনার মুকুট নিয়ে আছড়ে পড়ছে চোখের সামনে! সবুজ না নীল বুঝতে না বুঝতে ফিরে যাচ্ছে ঢেউয়ের পাহাড়, আর সেই জলের ছিটা লাগছে চোখে মুখে। মন প্রাণ ভরে যাচ্ছে অপূর্ব শীতলতায়। "খেলিছে জলদেবী সুনীল সাগর জলে, তরঙ্গ লহর তুলে লীলায়িত কুন্তলে"। নুসা দুয়া র কল্পিত সৌন্দর্য যেন হুবহু মিলে গেল।

রাতে ছিল জাহাজ ভ্রমণ। সূর্যডোবার পালা কে চাক্ষুষ করলাম বিশাল জাহাজের ডেক থেকে। নীচে চলছে খানাপিনা নাচগানের আসর। বালি সুন্দরীদের কাছ থেকে দেখা।

বালি র অন্যতম একটা জায়গা হল তনাহ্লোট মন্দির(Tanha Lot Temple)। মহাসমুদ্রের বক্ষে এক পাথুরে স্থাপত্য যা দেশ বিদেশের মানুষের কাছে অন্যতম আশ্চর্যের বস্তু। এই বৌদ্ধ মন্দির কে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল গ্রাম বালির ঐতিহ্য, শিল্পকলাকে সম্বল করে। অপূর্ব সাজানো বাগান, বিশ্রামস্থল, যেদিকে তাকাই সেদিকেই শিল্পীর ছোঁওয়া। সারি সারি দোকানে বালির ঐতিহ্যবাহী পসরা সাজিয়ে চলছে কেনা বেচা, আর দূরে সমুদ্রের গর্জনের মাঝে মন্দির, সাদা ফেনার ঢেউ তার পদচুম্বন করে যাচ্ছে বারে বারে, অগণিত পর্যটক ঘোরাঘুরি করছে সমুদ্রের জলে পা ডুবিয়ে। সূর্যাস্তের পালা শুরু হয়েছে। মন্দিরের মাথার সূর্য নেমে আসছে সমুদ্রের গভীরে তার সাথে একাত্ম হতে। আহা- এ সেই অবর্ণনীয় সৌন্দর্য যার জন্যে দেশ দেশান্তরের লোক ছুটে আসে চক্ষু সার্থক করতে।

এরপরে দেশে ফেরার পালা। বালির স্মৃতি বুকে নিয়ে সিঙ্গাপুর হয়ে ফিরে চললাম স্বদেশের মাটিতে।





















 
 
 

Comments


bottom of page