top of page

ক্ষমারূপেণ সংস্থিতা (অনুস্মিতা ভট্টাচার্য)

প্রতিদিনের মতোই নিধির ওয়ার্ডে ব্যস্ততা তুঙ্গে। আর হবে নাই বা কেনো, তাঁর হাত ধরেই তো রোজ শত শত প্রাণ জন্ম নিচ্ছে এই সুন্দর পৃথিবীতে। এমনিতে এই সময়টায় ফোন ঘাঁটাঘাটি করার সুযোগ বা সময় পায় না সে। আজ একটু ফাঁকা কারণ ডক্টর একটু তাড়াতাড়ি এসে ওয়ার্ড ভিসিট শেষ করে ফিরে গিয়েছেন। তাই হিসেব মতো তারপরেই ওয়ার্ডের ডিনার টাইম চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই খুব ফাঁকা না হলে সে বসার সুযোগও পায় না।

এদিকে আবার শুভরও নাইট ডিউটি আজ। তাই ওকেও ডিস্টার্ব করা যাবে না। তাই একটু ফোন স্ক্রল করছিল নিধি। ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো একটা পোস্ট দেখে। আর এক মাস পরেই পুজো। ছবিতে মায়ের সুদীর্ঘ মূর্তির সামনে নতমস্তকে এক বছর কুড়ির মেয়ে। মনে মনে নিজেকে কল্পনা করে নিলো সে। চোখের সামনে খেলে গেলো অনেক স্মৃতি, অনেক অন্ধকার।

অন্ধকার গলি থেকেই তো তাকে তুলে এনেছিল বিন্নি, চাওয়ালি। না, মা। লোকে তাকে চাওয়ালি বললেও বিন্নি তো আসলে নিধির মা। জন্ম দেয়নি কিন্তু যে ভালোবাসার ঋণ চাপিয়ে গেছে নিধির উপর তাতে পোশাক মলিন হতে পারে সম্পর্ক নয়। মেয়েকে মানুষ করতে লড়াই করেছে রাস্তায় রাস্তায়। কেউ তাকে চায়ের ঠেলাগাড়ি নিয়ে বসতে দিত না। নিধি একটু গিয়ে এর পর পা ধরত, মাঝে মাঝে এর ওর মাল বয়ে দিত। এভাবেই মাকে একটু দোকান করার জায়গা করে দিতে পারতো সে।

জন্ম থেকে বিকলাঙ্গ মা যে আবার দৌড়াতে পারে না। বাপটাও ছেড়ে চলে যায় নিধি আসার পর। কারণ সে নাকি টানাটানির সংসারে বোঝা। মা অনেক বোঝায়। বাপের তখন মাথায় শুধুই মদের টাকা যোগানোর চিন্তা। মেয়েকে সব দিলে বাপ গিলবে কী? এই ভেবে এক বাবুর বাড়ির কাজ পেয়ে ছুট লাগালো পাতানো বাবা। আর ফিরে এলো না সে। তারপর নিধি আর বিন্নি মিলে সংসার সাজিয়েছে ব্রিজের নিচে। পুজোয় জুটতো আধ-ময়লা কাপড় কিন্তু মেয়েকে সে একটা জামা কিনে দিতোই। সেই জমা পরেই মেয়ের কী আনন্দ। সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে ছুটত আর পাড়ায় পাড়ায় ঠাকুর দেখত একাই। দুগ্গা ঠাকুরের কাছে প্রতিবারই একটাই প্রার্থনা করত মায়ের যেনো কষ্ট না হয়। মায়ের মুখে যেনো হাসি রাখতে পারে সে ধরে।

কিন্তু মেয়েটা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যেই বেরোলো মায়ের চিন্তা বাড়লো। "মা তোকে তো আর পড়াতে পারবো না বাপ, টাকা কই?" চিন্তিত মায়ের মুখের দিকে চেয়ে মেয়ে তখন ঠিক করে একটা চাকরি যা হোক করে জুটিয়ে নার্সিং পড়া শেষ করবেই আর মায়ের জন্যে একটা মাথা গোঁজার আশ্রয় খুঁজবে। টিউশন ধরলো নিধি। যা আসতো সেটা জমিয়ে জমিয়ে নিজের পড়ার খরচ জোটালো নিধি। মাও একটা বাবুর বাড়ির বাচ্চাকে দেখাশোনা করার কাজ ধরলো। অবশেষে নিধি আজ নিজের আর মায়ের পরিশ্রমে সরকারি হাসপাতালের নার্স। আজ সে হাজার হাজার ইন্টার্ন মেয়েকে রোজ শিক্ষা দেয় নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ানোর। সে আজ অনেক মেয়ের নিধি দিদি।

যাক, আজ সুদিন ফিরেছে। মাকে আর কষ্ট করে এর ওর বাড়ি কাজ খুঁজতে হয় না। নিজেদের একটা বাড়ি হয়েছে ওদের। তারপরে জীবনে এসেছে শুভ যে নিধির সব দুঃখ ভাগ করে নিয়েছে। মায়ের দেখাশোনা স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে করে। রোজ অফিস ফেরত মায়ের সঙ্গে দেখা করে যায় নিধি। হঠাৎ মনে পড়ল এবার বিয়ের পর ওর প্রথম পুজো। এই প্রথম শুভ ওকে ওদের দেশের বাড়ি নিয়ে যাবে। আসলে এই কাজে তো নিধির ছুটি কম তাই বিয়ের পরও বেশিদিন ছুটি পায়নি। এবার তাই পুজোর ছুটিতে যাবে শ্বশুরবাড়ি। তাও আবার উত্তরবঙ্গে। পাহাড়ে ওর খুব যাওয়ার ইচ্ছে। জঙ্গলের গভীরে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চায় সে। সব পূরণ করবে শুভ কথা দিয়েছে। কিন্তু এবার যে প্রথম পুজো!

মাকে না নিয়ে গেলে হয়? মা যে ওর সব। মাকে ছাড়া ও আনন্দ করে কীভাবে? তাই এবার ভাবলো মাকে নিয়েই যাবে ওই বাড়ি। সবার সঙ্গে ওর মায়ের আলাপটাও হয়ে যাবে এই ফাঁকে। আর অত লোকের ভীড়ে বন্ধু হিসেবে শুভর পরেই পাবে মাকে। এখন থেকেই মনটা আনন্দে আচ্ছন্ন ওর। ছুটির অ্যাপ্লাইটা এবার করে ফেলতে হবে।

অবশেষে ছুটি পেয়েছে নিধি। শুভও ম্যানেজ করতে পেরেছে অফিস। এক সপ্তাহের টানা ছুটি। অনেক প্ল্যান করে ফেলেছে নিধি। সবগুলো তো শুভকে বলাও হয়নি। আর টুকটাক শপিংগুলোও করছে সে এই বাড়ি, বর আর শ্বশুরবাড়ির জন্যে। সেগুলো সারপ্রাইজ দেবে সে ওই বাড়িতে গিয়ে সবাইকে। আর বাড়ির বড়বৌ হিসেবে যে তার কপালেও কত আদর জুটবে এটার কিছুটা সে টের পেয়েছে। বাকিটা এবার পুজোয় হবে এটা সে নিশ্চিত। এখন কাজের মাঝে সুযোগ পেলেই নিধি এই নিয়েই ভাবছে। আসলে এটা তার প্রথম পুজো নয় কিন্তু এইবারের পুজোয় তার অনেক শান্তি আছে, আনন্দ আছে। ওই বাড়ির পাড়ায় মহিলারা এতটাও অগ্রসর হতে পারেনি। তাই তারা নার্সদিদি হিসেবে ওকে পেয়েছে। সবাইকে নিয়ে নিজের সোনার সংসারের আনন্দ,স্বপ্ন সব ভাগ করে নেবে।

এত কিছু ভেবে সময় তো যেনো আর এগোয় না। এদিকে নিধির উচ্ছাস পৌঁছে গেছে ওয়ার্ড পর্যন্ত। সদ্য মা হওয়া মেয়েগুলো যারা নার্স নয়, বরং নিধি দিদি বলতে অজ্ঞান তারাও দিদির আনন্দ টের পেয়েছে। আসলে ও তো বরাবর মিশুকে তাই ওকে গাম্ভীর্য শোভা দেয় না। হাসপাতালের সব মেয়েদের, কমবয়সীদের কাছে তাই ও নার্স দিদি নয়, নিধি দিদিই হয়ে ওঠে খুব তাড়াতাড়ি। আর একটু মন খারাপ ওই কচি কচি সন্তানসম বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে কয়দিন থাকতে হবে ওকে এটা ভেবে। এমনি করেই দিন কাটে।

মাহেন্দ্রক্ষণ প্রায় এসে উপস্থিত। যাওয়ার গোছগাছ চলছে। ওয়ার্ড থেকে এবার সবাইকে বিদায় জানিয়ে বেরোবে ও। ঠিক এমন সময় ছুটে এলো সোমা।

"দিদি দিদি একটা ইমার্জেন্সী গো"

"কী হলো রে তুই ঘামছিস কেনো?"

"দিদি বরটা মনে হয় কিছু করে দিয়েছে দিদি পোয়াতি মেয়েটা ছটফট করছে"।

নিধি ব্যাগ ফেলে দৌড়ে গেলো। ব্লিডিং হয়ে গেছে খুব। বাচ্চাটা বাঁচবে কিনা আর ঠিক নেই, মেয়েটাকে তো বাঁচাতেই হবে। কিন্তু আর কিছুক্ষন পরেই তো ট্রেন দিয়ে দেবে ওদের। গৌড়বঙ্গ এক্সপ্রেস। শুভ ফোন করেই যাচ্ছে। মা ফোন করছে। চিন্তায় আছে সবাই ও বুঝতেই পারছে। কিন্তু নিধি এটাও বুঝে গেছে ও যেতে পারবে না। চোখের জলটা মুছে তাড়াতাড়ি সোমাকে বললো "মেয়েটাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকা। স্যালাইন শুরু কর। আমি আসছি"।

"হ্যালো শুভ, আমার একটা ইমার্জেন্সী এসে গেছে গো। "

"মানে? তুমি আসছ না স্টেশন? আর আধঘন্টা পরে আমাদের ট্রেন ছেড়ে দেবে। আমি এসে গেছি লাগেজ নিয়ে। এখন মজা করার সময় নয়।"

"আমি মজা করছি না। সিরিয়াস কেস, এখনই অপারেশন করতে হবে। বাচ্চাটা বাঁচবে কিনা জানিনা। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো মা আর সন্তানকে ফেরাতে মৃত্যুর মুখ থেকে। কিন্তু তোমার বিশ্বাস না পাওয়া অবধি আমি পারবো না শুভ। তুমি শুধু একবার বলো আমি পারবো।"

"পাগলী মেয়ে, তুমি পারো না এমন কিছু হয় নাকি। এই যেমন এখন শেষ মুহূর্তে এসে এতক্ষণ অপেক্ষা করাতে পারলে আমাকে..."

"প্লিজ এমন বলো না। ওদিকটা তোমাকে সামলাতে হবে। এদিকটা আমি সামলাবো। পারবো না আমরা?"

শুভ বুঝে গেছে এই পাগলীর মাথায় এখন অপারেশনের ভূত চেপেছে। এটা নামানো ওর পক্ষে কেনো, স্বয়ং ঈশ্বরের পক্ষেও সম্ভব নয়। অগত্যা এ যাত্রা বাড়ি যাওয়া হলো না ও বুঝেই গেছে। তাই বললো

"নিধি তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আর আমিও তোমার অর্ধেক দায়িত্ব ভাগ করার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। সুখ-দুঃখ সব। আজ চরম পরীক্ষা আমাদের। পাশ করতেই হবে। আজ পাশ করলে আমরা সাত জন্ম জুড়ে থাকবো। তুমি যাও, আমি অপেক্ষায় রইলাম।"

তারপরেই ঝড়ের বেগে ছুটলো নিধি। হাতের কাঁচি তখন ছুটছে গৌড়বঙ্গ এক্সপ্রেসের মতো। রুদ্ধশ্বাসে সর্বশক্তি দিয়ে এক মাকে বাঁচিয়ে আনতে চাইছে সে। দুটো প্রাণ ওর হাত দিয়ে চলে যাবে এটা সে পারবে না। এই হাতেই সে প্রাণ বাঁচানোর প্রতিজ্ঞা করেছিল যে। এই হাত থামবে না আজ। দুটো হাতের মেলবন্ধন করেই থামবে সে।

অবশেষে এলো সেই সুন্দর মুহূর্ত। চোখ মেলে চাইলো মা। আর ভূমিষ্ঠ সন্তান তখন মায়ের ওম পেতে চাইছে। এই প্রথম শিশুটির চিৎকারে আত্মতৃপ্তি হলো নিধির। সে জয়ী আজ। এমন ভাবতে ভাবতেই মেয়েটি কোনোভাবে ডাকলো নিধিকে। সে কাছে এলো। মেয়েটি দুইহাত জোড় করে প্রণাম করতে চাইলো তার ত্রাতাকে। আর তার দুইদিন কেটে গেলো। মেয়েটির সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে নিধির। দুজনের আলাপ এখন গিয়ে ঠেকেছে দিদি আর বোনে। নিধি ওকে বলেছে এবার ও সুস্থ হলে ও মেয়েটি আর তার সন্তানকে নিয়ে গিয়ে মেয়েটির স্বামীর হাতে তুলে এমন বকা দেবে যে সে দ্বিতীয়বার আর প্রাণ নেওয়ার চিন্তা মাথাতেও আনবে না।

এভাবে আরো দুইদিন কেটে গেলো। আজ ষষ্ঠী। এক দেবীর বোধন হলো আজ আর আরেক দেবীর নিজের গৃহে প্রবেশ। সেই মেয়েটিকে নিজে পৌঁছাতে গেলো নিধি। ব্যাগভর্তি ফল, দুধের কৌটো সব দিয়েছে নিধি। বাড়ির দুয়ারে এসে দেখে স্বামী বাইরে বসে। নিধি তো দেখেই বললো "তো তুমিই সেই কর্তা?" লোকটি চিনতে পারেনি। মেয়েটি সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে শাশুড়ি বেরিয়ে এলো। নিধির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল ছেলের কীর্তির জন্যে। নিজের অশিক্ষার জন্যে লজ্জিত হলো ছেলেটি।

নিধিকে তারা ঘরে এনে বসালো। চা বানাতে বানাতে শাশুড়ি খানিক আলাপ জমালো নিধির সঙ্গে। কোথায় থাকে, কে আছে বাড়িতে সব বললো নিধি। তারপর মহিলাকে বললো মাসিমা ছেলেকে বলবেন সবাই মাতৃসুখ আর পিতৃসুখ একসঙ্গে পায় না। কেউ কেউ জন্মগতই মা-বাবার বোঝা হয়ে ওঠে। নিজে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ব্রাত্য হয়ে যায় সে। ক্ষণিক থেমে গেলো নিধি। গলা জড়িয়ে এলো।

বৃদ্ধ মহিলা নিধির চোখের কোণে জল দেখতে পেলেন। কী জানি কী ভাবলেন তারপরে বললেন "কিছু মনে না করলে মা একটা প্রশ্ন করব? তোমার চোখের জল বলছে তোমার কোনো অতীতের ক্ষত রয়েছ যা এখনও তোমাকে কাঁদায়। কী সেই ক্ষত? আমাকে মা না ভাবলেও মাসি ভেবেই বলো।"

আর কান্না ধরে রাখতে পারল না নিধি। এত বছর সেই কষ্ট বুকে নিয়ে ঘুরেছে সে। বারবার মা-বাবার পরিচয় খুঁজেছে সে। আসলে তার পালিকা মা তার থেকে সত্যিটা লুকায়নি। কারণ সে চায়নি পরে অন্য কারুর মুখ থেকে সত্যিটা জেনে অবাঞ্ছিত কষ্ট আরো বেড়ে যাক নিধির। তবু সত্যিটা জেনে নিজের মা বাবাকে অনেক খুঁজেছে সে। আর এইসব সে বলে চললো এক নিশ্বাসে। যখন থামলো দেখলো মাসিমার চোখ থেকে জল ঝরছে অঝোর ধারায়।

"কী হলো মাসি?"

"মা রে, আমিই তোর মা। তোকে মায়ের নাম দিতে পারিনি কারণ তোর বাবা চায়নি। তোর বাবা চায়নি অভাবের সংসারে মেয়ে আসুক। মেয়ে তার কাছে বোঝা। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওকে বোঝাতে কিন্তু সে বোঝেনি। আর আমার একার এত ক্ষমতা ছিল না তোকে একা মানুষ করবো। কিন্তু আজ আমি গর্বিত এমন রত্নগর্ভা হতে পেরে। তুই আমাকে স্বীকার করিস বা নাই করিস আমার এই জন্ম সার্থক। তোকে চোখের সামনে দেখতে পেলাম এই বা কম কীসের!"

নিধির হাত কাঁপছে। সে বুঝতে পারছে না কী করবে সে। এতদিন যে উত্তর খুঁজেছে আজ স্বয়ং তাকেই পেয়েছে অথচ আজ কঠিন বাস্তবের মুখে সে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে সে বলল, "পুজোর দিনে মায়ের চোখের কান্না কি মেয়ে সহ্য করতে পারে?" মা মেয়ের সেই চিরন্তন মুহূর্তের চিরসাক্ষী হয়ে থাকলো একজন... সে নিশ্চয় মনে মনে আসছে আজ। আবহে পাড়ার মাইকে বাজছে "যা দেবী সর্বভূতেষু ক্ষান্তিরূপেণ সংস্থিতা"।



অনুস্মিতা আমাদের বনশ্রী-নন্দিনী

Comments


bottom of page