top of page

লাদাখের রাস্তায় (অতনু চৌধুরী)

২০শে মে ২০২২ সকাল ৫:৩০,গ্যারেজ থেকে গাড়ি বার করে স্টার্ট করলাম। যাত্রা পথের সাথী আরও চারজন অপেক্ষায় রয়েছে হেস্টিংস এর মোড়ে, তাদের নিয়ে লট বহর ছাদে তুলে গাড়ি ছোটাতে লাগলাম। পরবর্তী গন্তব্যস্থান ডানকুনি টোল প্লাজা, সেখানে অপেক্ষায় রয়েছে আরো পাঁচ জন বন্ধু এবং আরও একটি গাড়ি। আমাদের গন্তব্য লাদাখ। নামটাতেই একটা অন্যরকম আকর্ষণ আছে। ভ্রমণ প্রিয় বাঙ্গালীর কাছে দেশ-বিদেশের যতই নামকরা বেড়ানোর জায়গা থাক না কেন, লাদাখ নামেই একটা শিহরণ জেগে ওঠে। তার উপর যদি বাই রোড যাওয়া হয় তাহলে তো কথাই নেই। যাই হোক চা পর্ব সেরে মূল যাত্রা শুরু। দিল এখন পুরো গার্ডেন গার্ডেন। সকাল নটা নাগাদ আসানসোল। ব্রেকফাস্ট করে ঝাড়খন্ড প্রবেশ। ধানবাদ আর ঝড়িয়া পার করতেই ধুলো ধোঁয়া শেষ, জঙ্গল পাহাড় শুরু। তোপচাঁচি পরেশনাথ পার করে বিহারের কোন এক অজানা গ্রামের ধাবায় দুপুরের ভোজন। সন্ধ্যা নাগাদ বেনারস। প্রয়োজনীয় কিছু রসদ সংগ্রহ করে এগিয়ে গেলাম আরো প্রায় ৬০ কিলোমিটার। রাজপুত ধাবা, গোপিগঞ্জ এ সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ আশ্রয় নিলাম। নামে ধাবা হলেও পুরোদস্তুর হোটেল। সকাল ন'টায় আবার যাত্রা শুরু। কানপুর হয়ে গাড়ি ছুটছে আগ্রার দিকে। কানপুরের ফ্লাইওভার যেন শেষ হতে চায় না ২৫-৩০ কিলোমিটার লম্বা তো হবেই। শিল্পনগরীর ভিড় এড়িয়ে কখন যে শহর অতিক্রম করলাম বুঝতেই পারলাম না। পথে এটোয়া ও আরো কিছু শহর নগর পার হয়ে দুপুর নাগাদ পৌঁছলাম আগ্রার কাছাকাছি। এরপর যমুনা এক্সপ্রেস ওয়ে। গাড়ির স্পিডোমিটারের কাটা দেড়শ ছাড়িয়ে আরো এগিয়ে চলেছে। ১৭০ - ১৮০ প্রতি ঘন্টা। স্পিড থ্রিলস বাট কিলস মেনেও গতির রোমাঞ্চ ধরে রাখা। রাস্তার পাশে ফুড হাবে দুপুরের লাঞ্চ। এক্সপ্রেসওয়ে তে কিছু দূরে দূরেই টয়লেট ও ফুড হাব আছে। সারা ভারতের সব প্রদেশের খাবারই পাওয়া যায়। পকেটে পয়সা থাকলেই হল। দাম যদিও বেশ বেশি আমাদের কলকাতার লোকেদের আরো বেশি মনে হবে। সন্ধ্যা নাগাদ পৌছালাম সোনপত।

২২ তারিখ সকাল ন'টায় যাত্রা পুনরারম্ভ। মনটা আজ একটু বেশি চনমনো। বহু প্রতীক্ষিত পাহাড়ের দর্শন হবে আজ। পানিপথ হয়ে গাড়ি চন্ডিগড়ের পথে। সেখান থেকে কিছুটা এগোলেই পাহাড়ের রাস্তা শুরু। একটু ভুল হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ রাস্তায় লাট খেয়ে অবশেষে সঠিক পথের দিশা পেলাম। মাঝে মাঝে গুগল বাবাজিও গুগলি দিয়ে ফেলে। প্রথমে মানালি ভায়া শিমলার রাস্তা ধরে ফেলেছিলাম। তারপর সংশোধিত রাস্তায় এলাম, শিমলা কে বাইপাস করে মানালির পথে। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ পৌছালাম মান্ডি। অতঃপর পাহাড়ি পথে রাত্রে ছোটাছুটি না করে মান্ডিতেই রাত্রিবাসের পরিকল্পনা হলো। মানালি তখনও প্রায় তিন চার ঘন্টার রাস্তা।

সকালে ঘুম ভাঙলো বিয়াস নদীর কুলু কুলু আওয়াজে। নদীর তীরেই হোটেল। পায়ে হেঁটে খানিক শহর পরিক্রমা হল। হিমাচলের অন্যতম জেলা শহর মান্ডি। জমজমাট ব্যবসার জায়গা। সকাল দশটায় বের হলাম মানালির পথে। রাস্তায় এক জায়গায় রিভার রাফটিং হল। বিকেল নাগাদ পৌছালাম মানালি।

মানালিতে দিন দুয়েকের অবসর। এখানে আগেও এসেছি, কিন্তু বেশ হতাশ হলাম এবারের দর্শনে। আধুনিকতার ছোঁয়া প্রতিটি কোনায়। প্রকৃতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সভ্যতা বেড়ে চলেছে চতুর্দিকে। রাত এগারোটাতেও দোকান খোলা দেখে মনে মনে বেশ কষ্ট পেলাম। গমগম করে বাজছে ডিস্কোর সাউন্ড সিস্টেম। বাইরে বাউন্সারদের কড়া পাহারা। বুঝতেই পারছেন মানালি কতটা উন্নত হয়েছে। পায়ে হেঁটে দুটো দিন ঘুরলাম উদ্দেশ্যহীন ভাবে। হিরিম্বা মন্দির, মনোমন্দির, রোটাং বা সোলান ভ্যালি দেখার ইচ্ছে মনে ছিল না। হিরিম্বা মন্দির অবশ্য গেছিলাম একবার। সেখানকার অন্ধকারাচ্ছন্ন পাইন গাছের ভিড়ে। নিচ থেকে পায়ে হেঁটে সিঁড়িপথের দুপাশে স্থানীয় লোকেদের পসরা র ভিড়। বেশ বোঝা যাচ্ছে ভার্জিনিটি অনেকদিন আগেই হারিয়েছে। পাহাড়ি পথেও একমুখী যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাতেই বোঝা যায় কি বিশাল চাপে আছে মানালি।

দুদিন বিশ্রামের পর আবার যাত্রারম্ভ ফাইনাল ডেস্টিনেশন এর দিকে। গাড়িতে দূরযাত্রার সময় পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়াটা খুব জরুরী। শরীরকে উচ্চতা জনিত সমস্যার সাথে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপার থাকে। পুরানো সেই রোটাং হয়ে লেহ্ যাওয়ার রাস্তা এখন অতীত। অটল টানেল হয়ে নতুন পথে যাত্রা তুলনায় অনেক মসৃণ, রাস্তা ও প্রায় ৪৫ কিলোমিটার কম। বর্তমান দূরত্ব ৪৩০ কিলোমিটারের। মানালি থেকে অটল টানেল ৩৩ কিলোমিটার। একটাই টানেলে দুই মুখী গাড়ি চলার ব্যবস্থা। দৈর্ঘ্য প্রায় নয় কিলোমিটারের কিছু বেশি। আধুনিক সমস্ত সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ এই টানেল।

সিসু, কেলং পেরিয়ে গাড়ি চলেছে মানালি-লে হাইওয়ে ধরে। পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে হঠাৎ করে ভেসে উঠছে ছোট্ট কোন গ্রাম। মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে মেষপালকের দল। রাস্তা অবরোধ করে চলেছে প্রচুর ছাগল ভেড়া নিয়ে। প্রত্যেক দলে চার পাঁচ জন করে মেষপালক, সঙ্গী একটি বা দুটি সারমেয়। কখনো কখনো দুই একটি গাধা বা খচ্চর টাইপের প্রাণী। তারা রয়েছে আগামী কয়েক মাসের রসদ বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বহু পুরনো ও কষ্টকর এই প্রফেশন হিমাচল ও কাশ্মীর অঞ্চলে বেশ চালু। গরমের সময় তারা পালিত পশু নিয়ে যায় কোন বুগিয়াল বা ঘাস জমিতে চড়াবার উদ্দেশ্যে। বরফ গলার পর মাঠের নতুন বের হওয়া কচি ঘাস পোষ্যদের বেশ পুষ্টিকর খাদ্য। শীতের শুরুতে আবার ফিরে আসে নিজেদের গ্রামে।

এ পথে অনেকেই জিস্পাতে যাত্রা বিরতি নিয়ে থাকেন কিন্তু জিস্পা থেকে লেহ্ এর দূরত্ব বেশ কিছুটা বেশি। একদিনে পৌঁছানো বেশ চাপের। আমরা ঠিক করলাম সারচু পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়ার। হাতে সময় আছে। গুগল এর হিসাবে মানালী থেকে সারচু যেতে লাগার কথা সাড়ে চার ঘন্টা। কিন্তু ভাগ্য খারাপ, দারচা তে আটকে গেলাম। ব্রিজের ওপারে কোন এক অজ্ঞাত স্থানে পাহাড় থেকে পাথর পড়ছে। লাইন করে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। প্রায় ঘন্টা দুয়েক আটকে থাকার পর প্রাথমিকভাবে ছোট গাড়ি যাবার অনুমতি পাওয়া গেল। ছটা নাগাদ সারচু তে পৌঁছালাম। সারচু একটা প্রায় জনবিরল স্থান। মিলিটারি ক্যাম্প ও বেশ কিছু টুরিস্ট টেন্ট ছাড়া আর কিছু নেই। হিমাচল ও লাদাখের সীমান্তে এই গ্রামটি। বছরের ৩-৪ মাসের বেশি টুরিস্ট-টেন্ট খোলা থাকে না। শীতের প্রারম্ভে বরফ পাত শুরু হয়ে যায়, তখন রাস্তা বন্ধ। উচ্চতাজনিত সমস্যাগুলি বেশ টের পাচ্ছি। মাথা ধরা, মাথা ভার হয়ে আছে। বেশি নড়াচড়া করলেই মুশকিল। এখানে গাছ-গাছালি তো দূর, কোথাও কোন কাঁটা গাছের ঝোপও নেই। ডেজার্ট হিল যাকে বলে। অক্সিজেনের পরিমাণ কম। বেশি ঘোরাঘুরি না করে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। খাবারের আয়োজন খুব সামান্য। খিচুড়ি ও অমলেট। অনেক দামাদামির পর মাথাপিছু হাজার টাকাতে রাতটুকু থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। সকালে উঠে চোখ জুড়িয়ে গেল। ন্যাড়া পাহাড়ের দৃশ্য যে এতটা সুন্দর হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। ক্যাম্পের পিছনে বয়ে চলেছে নদী। দূর পাহাড়ের চূড়া বরফ ঢাকা। সামনের পাহাড়গুলি যেন রঙ্গোলিতে সাজানো।এক একটা পাহাড়ের রং এক এক রকম। কোথাও লাল, কোথাও হলুদ, কোনটা আবার সোনা রঙে রাঙানো। এছাড়াও বেগুনি, কালো কি নেই! সব রঙের ছোঁয়া রয়েছে সেখানে। কালো পীচের রাস্তা পাহাড় গুলির ফাঁকফোঁকর দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে দূর থেকে আরো দূরে। আকাশের রং গাঢ় নীল। ছবির প্রেক্ষাপটের একদম উপযুক্ত।




বিকেল-বিকেল এসে পৌছালাম লেহ তে। রাজ নিবাস বা গভর্নর হাউজের কাছে একটা হোটেলে উঠলাম। এখানে বলে রাখা ভালো সারচু থেকে লেহ্ আসার সময় প্যাঙ্গম লেক ও নুব্রা ভ্যালি দেখে আসলে সময় ও খরচ কম লাগে। যাত্রাপথের মাঝে যেকোনো চেকপোষ্টে আধার কার্ড দেখিয়ে পারমিট করে নেওয়া যায়। এ জন্য কোন খরচ লাগে না। তবে প্রত্যেক যাত্রীর আই কার্ড থাকা বাধ্যতামূলক। প্যঙ্গম যাওয়ার রাস্তা বেশ খারাপ। রাস্তায় কোনো পেট্রোল পাম্প নেই, তাই গাড়ির ট্যাংক আগেই ভর্তি করে নিতে হবে।




লেহ্ থেকে আমরা পরদিন বেরোলাম খারদুংলা পাস এর উদ্দেশ্যে। পথে এক জায়গায় চেকপোস্টে আমাদের পারমিট করে নিলাম। খারদুংলা, নুব্রা, প্যাঙ্গম ও ম্যাগনেটিক হিল এর জন্য পারমিট একেবারেই করে নেওয়া যায়। খারদুংলা র দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। প্রায় দেড় ঘন্টার রাস্তা। শহর পার হয়ে গাড়ি কেবল চড়াই পথে চলেছে। উচ্চতা প্রায় ১৮ হাজার ফুট। পৃথিবীর মধ্যে গাড়ি চলার সর্বোচ্চ পাস এটি। ভিউ পয়েন্টে বেশ কিছু টুরিস্টের ভিড়। চারদিক পাহাড় বরফ মোড়া। রাস্তার পাশে দশ ফুটেরও বেশি দেওয়াল বরফের। অন্য পাশে গভীর খাদ। বেশ কয়েক জায়গায় সেনাবাহিনীর তরফ থেকে সতর্কীকরণ বোর্ড রয়েছে। লেখা আছে কুড়ি মিনিটের বেশি থাকা নিরাপদ নয় শ্বাসকষ্ট ও মাথাব্যথার সমস্যা হতে পারে। বেশি কিছু হলে স্থানীয় হাসপাতাল অথবা সেনাবাহিনীর সাহায্য নেওয়া উচিত।ইত্যাদি।


সামনের রাস্তা সোজা চলে গেছে নুব্রা ভ্যালির দিকে। সেখানে বালিয়াড়িতে ২ কুঁজবিশিষ্ট উট দেখতে পাওয়া যায়। অতীতের সিল্করুট এটি। চীনের সাথে একসময় এই পথে ব্যবসা হতো। সিকিমেও এইরকম একটি সিল্করুট আছে। এখান থেকে নুব্রার দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার। সময় লাগে প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টা। আমরা নুব্রা যাওয়ার পরিকল্পনা ত্যাগ করে শহর ও তার চারপাশটা ভালো করে দেখা মনস্থ করলাম।


চলে গেলাম সেনা মিউজিয়াম, হল অফ ফেম দেখতে। পাকিস্তান ও চীন যুদ্ধে ব্যবহৃত বহু সামগ্রী এখানে রাখা আছে। জানা-অজানা যুদ্ধাস্ত্র এবং তাদের গুরু গম্ভীর নাম। এখানে পথের ধারে অনেক জায়গায় কিছু দোকান চোখে পড়ল। সেখানে সেনাদের ব্যবহারের অনেক জিনিস কেনাকাটা করা যায়। যেমন সেনা পোশাক, জুতো, বেল্ট, চশমা, টুপি, আরো অনেক কিছু। আশ্চর্যের বিষয় যে এগুলি যে কেউ কিনতে পারে। সেনাদের ব্যবহারের জিনিস এত সহজ লভ্য! কেমন যেন অবাক লাগলো। পরে দেখলাম কলকাতাতেও এরকম দোকান আছে।

পরদিন গেলাম প্যঙ্গম। পারমিট আগেই করা ছিল। রাস্তার অসুবিধা বাদ দিলে নির্ঝঞ্ঝাটে পৌঁছে গেলাম। অপরূপ সে লেকের সৌন্দর্য। কথায় প্রকাশ করা অসম্ভব। নীল জলে নিচ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। এই লেকের ৬০ শতাংশ নাকি চীনের অংশে। সে যাই হোক, সীমানা নিয়ে বিবাদ যারা করে তারা করুন। আপাতত লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করা অনেক আনন্দদায়ক। উল্টো দিক থেকে আসা হাওয়ায় জলের উপর হালকা ঢেউ তৈরি হচ্ছে। লেকের জলের কোন ব্যবহার নেই, ফলে দূষণও নেই। বড্ড ইচ্ছে হচ্ছিল জলে নেমে পড়ার। কিন্তু প্রবল ঠান্ডা সাধ আর সাধ্যের মধ্যে দেওয়াল তুলে দাঁড়ালো। ১৩৪ কিলোমিটার লম্বা এই লেকের জল নাকি নোনতা। যদিও আমি পরখ করে দেখিনি। অতিরিক্ত ঠান্ডা হওয়া ও বালুঝড়ের কারণে বেশিক্ষণ এই সৌন্দর্য উপভোগ করা গেল না। ফিরে এলাম লেহ্ তে। অবশ্য চাইলে এখানে থাকার ব্যবস্থা আছে। থ্রী ইডিয়টস্ এর সেই স্কুলও এখন দ্রষ্টব্যের বিষয়। লেক থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই তার অবস্থান।

একদিনে যাওয়া যায় শান্তিস্তুপ ও লেহ্ প্যালেস। দুটোই আমার হোটেল থেকে পায়ে হাটা দূরত্বের মধ্যেই ছিল। হোটেলের রুম থেকেও পরিষ্কার দেখা যেত।


ত্রিশে মে ফিরতি পথের যাত্রা শুরু। সকাল সাতটায় বেরিয়ে পড়লাম হোটেল ছেড়ে। টার্গেট সোনমার্গ, ৩৪০ কিলোমিটার পথ। লেহ্ এর সীমানা ছাড়িয়ে ম্যাগনেটিক হিলসকে পিছনে ফেলে গাড়ি চলেছে কারগিল কাক্সার বালতাল হয়ে সোনমার্গ এর দিকে। আশা ছিল সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যাওয়ার। কিন্তু বিধি বাম। দ্রাস এ বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল কারগিল যুদ্ধের ওয়ার মেমোরিয়াল দেখতে। ভারতীয় হিসাবে বেশ গর্ববোধ করছিলাম ওই সময়। এন্ট্রি ফী ২০ টাকা। কিন্তু হাতে করে টিকিট দেওয়া বা নেওয়ার ব্যাপার নেই। রাখা বাক্সে ফেলে দিন। কেউ নজর করে দেখার ব্যাপার নেই। মনে হয় একজন ও ফাঁকি দিয়ে ঢুকে যাওয়ার মানসিকতা দেখাবেন না। বেশ বড় একটা সুন্দর গোছানো পার্কের মত জায়গা, তা সাজানো আছে কারগিল যুদ্ধের নিহত বীর সেনানায়কদের আবক্ষ মূর্তি ও যুদ্ধে ব্যবহৃত বিভিন্ন আর্টিলারি দিয়ে। বিশেষ দ্রষ্টব্য বহু বিতর্কিত বোফর্স কামান। ১০ মিনিটের একটা ভিডিও শো হয় যার খরচ মাথাপিছু ১০০ টাকা। সেখানেও কোন নজরদারি নেই, কিন্তু কোন ফাঁকিও নেই। অমিতাভ বচ্চনের গলায় জানতে পারবেন ওই যুদ্ধের বহু অজানা বিষয়।




সন্ধ্যা হয় হয়। সোনমার্গ আর মাত্র ঘন্টা দুয়েকের ড্রাইভ। সেনাবাহিনীর চেকপোষ্টে গাড়ি থমকে গেল। সামনে গাড়ির লাইন। খোঁজ নিয়ে জানলাম দুপুর দুটো থেকে রাস্তা এক মুখো চলছে। শ্রীনগরের দিক থেকে গাড়ি আসছে। এদিক থেকে কখন গাড়ি যাবে বলা যাচ্ছে না। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়া ও বৃষ্টি। পরে বরফ পড়াও শুরু হলো। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে সকালের আগে রাস্তা খুলবে না। আগে রাস্তা তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি দুটো গাড়ি যাবে না তাই এই ব্যবস্থা। অনেকেই গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল কোন হোটেলে রাত কাটানোর আশায়।

আমরা ঠিক করলাম গাড়িতেই থেকে যাওয়ার। সকালে এলে আবার লম্বা লাইনে পড়তে হতে পারে। আবার রাস্তা আগেও খুলে যেতে পারে।

এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। রাত ৭ টার দিকে হঠাৎ শুরু হল গোলাগুলি। দূ=তোপ ডাকছে। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে কানের পাশে এসে পড়বে হয়তো। মাঝে মাঝে তোপ দাগার ঝলকানি দেখতে পাচ্ছি। মনে মনে ইষ্ট নাম জপ করা ছাড়া কিছুই করার নেই। একটা গোলা যদি আশেপাশে এসে পড়ে তবে কেল্লাফতে। হঠাৎ শুরু হওয়ার মতই রাত নটার পর আবার হঠাৎ করে চারিদিক নিস্তব্ধ। কোথাও কোন আলো নেই। গাড়িতে থাকা শুকনো খাবার ও ফলমূলের ভরসায় রাত কাটাতে হবে। বসে বসে ইউটিউবে সিনেমা দেখছি। আড়াইটা নাগাদ রাস্তা খুলে গেল। আমরা প্রথমেই ছিলাম, গাড়ি চলল সোনমার্গ এর দিকে, কিন্তু ওই রাতটা আমরা কেউ ভুলতে পারবো না।ইত্যাদি।=রাস্তার বাধাবিঘ্ন গুলো পার করে সকাল ছটায় পৌঁছলাম সোনমার্গ। এত সকালে কোন হোটেল খোলা নেই। দু-একটা যাও বা পাওয়া গেল কেউই এগারোটার আগে রুম দেবে না। অগত্যা চল শ্রীনগর! মাত্র ৮০ কিলোমিটার রাস্তা!

এর পরের কয়েকদিন শ্রীনগর, পহেলগাঁও, লুধিয়ানা, আগ্রা, সুলতানপুর এ রাত্রি বাস করে ছয়ই জুন ফিরলাম কলকাতায়। সেই গল্প অন্য কোন একবার হবে।










Comentarios


bottom of page