top of page

হবু বৌমার হবু শাশুড়ি (শুভ্রা সরকার)

"মা, শিগগির এসো, দেখো, কি কাণ্ড!" মেয়ের উচ্চকিত কণ্ঠস্বর শুনে সুমনা ভাবে হলো টা কি? এই সবে দুপুরের খাওয়া দাওয়া র পাট চুকিয়ে কিচেন টা কে গুছিয়ে গাছিয়ে বিছানায় পিঠ টা কে ঠেকিয়েছে, তার মধ্যেই মেয়ের চিল্লানি। আর ভালো লাগে না বাপু, বিশ্রাম বলে জিনিস টা যেন সুমনার অভিধানে নেই। সবসময় ছেলে, মেয়ে, বরের এটা কই, ওটা কই, এই দাও, সেই দাও লেগেই আছে। কবে যে এরা স্বাবলম্বী হবে কে জানে! অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠতে হলো। "বল কি হয়েছে। এত হাঁক ডাক করছিস কেন? একটু কি ঘুমাতে দিতেও পারিস না!" বলে ওঠে সুমনা রাগতস্বরে।

"আরে রাখো তোমার ঘুম! যা দেখাবো ঘুম সুরসুরিয়ে পালাবে।" মেয়ে শ্রেয়ার কথায় একটু রাগ ও হয়, আবার একটু কৌতুহল ও। "এই দ্যাখো" বলে ফোন টা এগিয়ে দেয় মেয়ে। সুমনা চশমা পরেই ফোন টা হাতে নিয়েই হাঁ হয়ে যায়। এ কি দেখছে সে! তার অতি শান্ত সুবোধ ছেলে কার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে! মা গো, এটাও দেখার ছিল? ডুকরে কেঁদে উঠতে মন করে। শাশুড়ি মাতা জানলে কি যে হবে কে জানে! বচনে বচনে অস্থির করে দেবেন। না, তবে আগে জানতেই হচ্ছে ব্যাপার টা কি? "এই, ফোনটা লাগা তো তোর দাদা কে! আগে নিই খবর টা!" মেয়ে বলে ওঠে, "আমিই বলছি, এ তোমার পুত্তুরের গার্লফ্রেন্ড। সরাসরি তোমাদের বলতে পারছিল না, তাই এই কায়দা। স্ট্যাটাস এ দিয়েছে ছবি টা। জানে আমি রোজ স্ট্যাটাস চেক করি, আমার চোখে পড়বেই, আর আমি দেখলে বাড়ি শুদ্ধ লোক দেখবে, জানবে। কষ্ট করে ওকে বলতে হবে না। একটু আগে কল করে সব জেনেছি।" "তাও ফোন কর" বলে ওঠে সুমনা। ফোন লাগতেই সুমনা ঝনঝনিয়ে ওঠে "মেয়েটা কি তোর গার্লফ্রেন্ড?" ওধার থেকে অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর "হুঁ"! "তোর এত সাহস! সামনাসামনি না বলে স্ট্যাটাসে ছবি দিয়েছিস! আসুক তোর বাবা! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন!" চিল্লিয়ে ওঠে সুমনা। "ঠিক এই জন্যই বলিনি। সামনে বললে এতক্ষনে কান টা কে আস্ত রাখতে!" বলেই ফোনটা কেটে দেয় ছেলে।

হাউ হাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে সুমনার। সব্বাই তাকে কথা শোনাবে। বুড়ি শ্বাশুড়ির কানে গেলে নিত্য গঞ্জনা দেবে- মা হয়ে ছেলেকে মানুষ করতে পারেনি। এখন কি করবে সে? টস টস করে জল গড়িয়ে পড়ে চোখ দিয়ে। খানিক ধাতস্থ হওয়ার পর ভাবে, আসুক কর্তা অফিস থেকে ফিরে। এই ব্যাপারটাকে কিভাবে নেয়, আর কি শোনাবে কে জানে! সব রাগ গিয়ে পড়ে ছেলের উপর। আরে বাবা আগের থেকে এই আভাস ইঙ্গিত দিলে এতটা বিপদে পড়তে হতো না। সে ঠিক বুঝিয়ে বুঝিয়ে রাজী করাতো ভালো বিয়ে করতে। অবশেষে এলো সেই মুহূর্ত। চা টা দেওয়ার পরে সুমনার উসখুস ভাবটা স্বামী রজতের চোখ এড়ায় না। খেতে খেতে মুখ না তুলেই বললেন "কি বলার বলেই ফেলো না।" সুমনা ছবিসহ ফোনটা এগিয়ে দেয়। রজত বাবু দেখলেন, তারপর ভাবলেশহীন মুখে জিজ্ঞাসা করলেন "কবে বিয়ে করছে কিছু বলল?"

সুমনার খাবি খাওয়ার অবস্থা। এত হালকা ভাবে কেউ এত সিরিয়াস ঘটনা কে নিতে পারে! নাম ধাম গোত্র বংশ পরিচয় না জেনেই কিনা বলে দিল কবে বিয়ে! একটু ঝাঁঝের সাথেই বলে সুমনা "তোমার কি মেয়েটার সম্পর্কে কিছুই জানার নেই? না জেনে বিয়ে দেবে?" রজত বাবু বললেন "তোমার ছেলেকে তুমি চেনো না? তোমার পছন্দ না হলে সে এই সম্পর্ক থেকে সরে দাঁড়াবে? তাহলে?" আসলে রজত বাবু জানেন তার একসময়ের মুখচোরা ছেলেটা ভিতর থেকে কতটা কঠিন। কাউকে কথা দিয়ে খেলাপ করে না প্রান থাকতে। তাই আর অযথা গন্ডগোল পাকাতে ইচ্ছা হলো না। কিন্তু আজ যেন সুমনাকে ভূতে পেয়েছে। কম কথার সুমনা বলে ওঠে "জানো মেয়েটা নন বেঙ্গলী! নিরামিষাসী! একটা এমএনসি তে চাকরি করে! এরকম একটা সম্পূর্ণ আলাদা কালচারের মেয়ে কি পারবে এ বাড়ির সাথে মানিয়ে নিতে?" রজত বাবু বললেন "কেন? আমরা সবাই মেয়েটাকে মানিয়ে নিলেই তো হল! একজনের দশজনের সাথে মানানো সোজা, না দশজনের একজনের সাথে?" সুমনা হা হয়ে গেল। এ সে কাকে দেখছে! কার কাছে সান্ত্বনা পাবে!

দুম দুম করে হেঁটে অন্য ঘরে চলে আসে সুমনা। একমাত্র কান্নাই তার সম্বল। কেউ তার দুঃখটা বুঝবে না। না স্বামী না সন্তান। হঠাৎ কাঁধে হালকা ছোঁয়ায় ঘোর ভাঙ্গে সুমনার। রজত পাশে বসে বলে "এত নারাজ হচ্ছো কেন? বাঙালি নয়, আর নিরামিষাসী বলে? আজকের দিনে এটা কোন সমস্যাই নয়!" "বলছো?" রাগত গলায় বলে সুমনা। "ঘরে সর্বদা হিন্দির চাষ হবে। তার থেকেও বড় কথা আমার বাবুটা মাছ মাংস কত ভালোবাসে। ও মেয়ে সেসবের তো ধার ও মানাবে না।" "ও এই কথা!" রজত বাবু বলে। "তা অনলাইন ডেলিভারি আছে কি করতে! ওদের কথা ওদেরই ভাবতে দাও না! আর হিন্দির কথা বলছো! ভালোই তো আমাদের আতা হ্যায় যাতা হ্যায় বলাটা ওর সংস্পর্শে একটু উন্নত হবে। আর আমাদের সাথে থাকতে থাকতে তার কলকাত্তা থেকে কোলকাতায় উত্তরন হবে!" "আর তোমার মা? তাকে কে বোঝাবে? তুমি? তিনি তো ভাববেন আমি ছেলেকে মানুষ করতে পারিনি।" রজত বাবু বললেন "তোমাকে অত ভাবতে হবে না। জানো তো আসলের থেকে সুদ প্যায়ারা!"

না এ লোককে নিয়ে পারা যাবে না। গুম হয়ে বসে থাকে সুমনা। "মা একটু জল দিয়ে যা না" রজত বাবু চেঁচিয়ে ডাকেন মেয়েকে। শ্রেয়া জল নিয়ে এসে বলে "ধর"। রজত বাবু বললেন "মাকে দে। একটু জল খেয়ে ঠান্ডা হোক।" "সেই তো! মায়েরই তো মাথা গরম!" ঝাঁঝিয়ে ওঠে সুমনা। মেয়ে বলে ওঠে "মা এমন কেন করছো? মেয়েটা সত্যি ভালো। আমি আর বাবা কথা বলে দেখেছি। কি নম্র, কত রেস্পেক্ট দিয়ে বাবার সাথে কথা বলছিল।" "বলিস কি? তোরা কি সব জানতি?" বিস্ময়ে চোখ ঠিকরে বেরোনোর জোগাড় সুমনার। "একটু শান্ত হও। দাদা এর আগেরবার এসে আমাকে আর বাবাকে সব বলেছে। ভিডিও কলে কথা বলিয়েছে। কিন্তু তোমার ওই বাঙালি বৌ চাই এর চক্করে সাহস করে বলে উঠতে পারেনি। মেয়েটা কিন্তু আন্টি মানে তোমার সাথেও কথা বলতে চেয়েছিল। বাবা বারণ করেছে। বলেছে আন্টিকে একটু সময় দাও। কিভাবে রিয়েক্ট করবে তুমি তাই তখন বলায় নি। আর এখন ও তো আমার আর বাবার ফেসবুক ফ্রেন্ডও।" "তোদের পেটে পেটে এত!" হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে সুমনা। "সবাই জানে, শুধুমাত্র যার জানার অধিকার সবার আগে সে ছাড়া!" মেয়ে চোখ মুছিয়ে বলে "কেন এমন করছ? শুধুমাত্র বাঙালি হওয়াটাই বড় কথা হলো? একটা সুস্থ মনের মেয়ে, যে তোমাকে ভালবাসবে, শ্রদ্ধা করবে, সেরকম বৌমা ই তো চেয়েছো। যদি প্রথমেই তুমি তাকে কিছু বলে বসতে, সে সারা জীবন সেটা মনে রেখে দুঃখ পেতো। তাইতো এরকম ভূমিকা করতে হলো। কাল সকালেই তোমার সাথে কথা বলাবো, দেখবে খুব ভালো লাগবে। " "আর তোর ঠাকুমা? তাকে কি বলবি?" সুমনা বলে ওঠে "মা ও নিয়ে ভেবো না। ঠাম্মি তাকে বাংলায় বলেছে তোমার মত শুদ্ধাচারি মেয়ের হাতে খাইতে আমার কোনো অসুবিধা হইব না!" "আর কিছু বলবি তোরা?"

না আর চাপ সে নিতে পারবে না। হঠাৎ বলে বসে "আমিও রাজি!" শ্রেয়া বাচ্চা মেয়ের মত হাততালি দিয়ে বলে ওঠে "বাহ, এটাই তো সবাই চাইছিলো। আমাদের সোনা মা"





Commentaires


bottom of page