top of page

অতনু চৌধুরী - বখশিশ

-বাপরে এবার একটু থাম না -

-সোনা এখন থামলে হবে? দেখছিস না আরতি হচ্ছে -

-আর কতক্ষন আরতি হবে? আমি যে আর পারছিনা, হাত টনটন করছে -

- সোনা ছেলে আমার, আর একটুখানি, ধর এই মিনিট দশেক‍‍! তারপর বিশ্রাম পাবি -

- সে তো তুই কালকেও বলেছিলি। তারপর যে আবার ধুনুচি নাচ শুরু হলো, সে তো আর শেষ হতেই চায় না। সারারাত ব্যাথায় আমি হাত নাড়াতে পারিনি তা তুই জানিস?

ছেলের কথায় মনে মনে হাসে মানিক। তা কি আর জানি না বাবা- তোর মতন কোন ছোট্টবেলা থেকে আমিও বাবার হাত ধরে শহরের পুজোমণ্ডপে রাতের পর রাত কাটিয়েছি। কিন্তু এই সরল সত্য কথাটি মুখ ফুটে বলতে পারে না ছেলে কে। সান্তনা দিতে বলে- দেখবি পরে সব অভ্যাস হয়ে যাবে, তখন আর সহজে হাত ব্যথা হবে না।

- তুই যে বাড়ি থেকে আসার সময় বললি শহরে গিয়ে বড় বড় পূজো দেখাবি তা কই ঠাকুর তো দেখাতে গেলিনা-

-এইতো ঠাকুর দেখছিস না! এও কি কম বড় পূজো নাকি

- ধুর, এ তো মাত্র একটা ঠাকুর। বাকি ঠাকুর গুলো কখন দেখাবি? তিন দিন ধরে এই একটা ঠাকুর দেখে তো চোখ পচে গেল।

- ঠাকুর কি আর আলাদা হয় রে খোকা! সব ঠাকুর তো একই রকম। দেখিস না সবখানেই মা দুর্গার দশ হাত, তা আমাদের কুসুমপুরেও যা, এই কলকাতা শহরে ও তাই। খালি খালি মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে কি হবে বলতো? তার চাইতে এই বেশ- দেখ কত লোক আসছে যাচ্ছে, ভালো নয়!

- ওরা তো সব নতুন জামা জুতো পড়ে ঠাকুর দেখতে বেড়িযেছে, তা আমাকে কবে জামা জুতো কিনে দিবি বাবা।

- এই তো, দশমী হয়ে গেলে তোতে আমাতে বাজারে গিয়ে নতুন জামা জুতো সব কিনবো, কি সুন্দর দেখাবে তখন আমার গোপালকে!

- তখন তো পূজো শেষ হয়ে যাবে। নতুন জামা পড়ে তখন কোথায় যাব!

এ কথার কোন উত্তর মানিকের কাছে নেই, বছর দশেকের ওইটুকু বাচ্চা কে কি বলে আর সান্ত্বনা দেবে ও। বাড়ি থেকে আসার সময় ছেলেকে মিথ্যা আশা দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল। এখন ছেলেকে কি বলে বোঝাবে সে। পুজোর এই কটাদিন ঢাক বাজিয়ে যে রোজগার টুকু হবে তা গ্রামে থেকে সারা মাস মুনিষগিরি করেও পাবে না। গতবছর তাও কাঁসর বাজানোর পাঁচশো টাকা অন্য একজন ফাঁকতালে মেরে দিয়েছিল। খুব আফসোস হয়েছিল তখন টাকা কটার জন্য। এবার তাই আগে থেকেই হিসেব করে গোপালকে নিয়ে এসেছে। সত্যি কথাটা বললে কিছুতেই ছেলেটা আসতো না। কলকাতা শহর ও বড় পূজো মন্ডপ দেখার লোভে এক কথায় রাজি হয়ে গেছিল সে।

তখন কি উৎসাহ ওর। কবে কলকাতা যাবো রে বাপ বলে প্রশ্ন করে করে মাথার পোকা নাড়িয়ে দিয়েছিল মানিকের। কিন্তু শিয়ালদা স্টেশনে নেমে হকচকিয়ে গিয়ে ছিল লাখো মানুষের ভিড়ে। ঘাবড়ে গিয়ে একদম সেঁটে গেছিলো বাবার শরীরের সাথে। তারপর যখন একটু ধাতস্থ হলো, তখন আবার বাবা চলো বাবা চলো বলে তাগাদা শুরু হলো। মানিক যখন হাতের ঢোল খানা বাজাতে শুরু করলো স্টেশন চত্বরেই, তখন আবার ব্যাপারখানা না বুঝে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো বাবার মুখের দিকে। মানিক ওকে ইশারায় ব্যাগ থেকে কাঁসর বের করে বাজাতে নির্দেশ দিল। আশেপাশের আরো অনেক ঢাকি ওদের মত ততক্ষণে ঢাকের বোল তুলে জমিয়ে দিয়েছে চারপাশটা। সবার দেখাদেখি গোপাল না বুঝেই ব্যাগ থেকে কাঁসর খানি বের করে লাঠি দিয়ে প্রাণপণে বাজাতে শুরু করে দিল। বাবা বলল ভালো করে বাজা গোপাল, মন্ডপের বাবুরা এখান থেকেই দেখবি আমাদের কত খাতির করে নিয়ে যাবে পুজো প্যান্ডেলে। উত্সাহে গোপাল হাতের শিরা ফুলিয়ে বাজাতে লাগল কাঁসরঘন্টা। ‍

অবশেষে, দুপুরের দিকে ৪ - ৫ জন লোক বাপের সাথে কি সব আলোচনার পর গাড়ি করে নিয়ে এলো ওদের এই মণ্ডপে। গাড়িতে আসতে আসতে সে কি অবস্থা গোপালের। চক্ষু একদম ছানাবড়া। কি সব পেল্লায় বাড়ি। যেন আকাশ ফুঁড়ে উঠে গেছে ওপর দিকে। দশ বিশ ত্রিশ তলা হবে বোধহয়। অতসব গুনতে পারা যায় নাকি! আর রাস্তায় কত যে গাড়ি, তার আর গুনতি নাই। তাও আবার রেলগাড়ি--গাড়ি সব একসাথে চলছে। এমন সব আজব ব্যাপার স্যাপার কখনো দেখেনি গোপাল।

এই পর্যন্ত তাও ঠিক ছিল। যে পুজো মণ্ডপে ওদের টেনে নামালো সেও কি বিরাট- কুসুমপুরের যাত্রার প্যান্ডেল ও কখনো এত বড় হয় না। কিন্তু তারপর থেকেই সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে গেল- বাবার কথাগুলো আর ঠিক মিলছে না।

মন্ডপের পিছনে এক চিলতে ঘরে ঠাঁই মিলেছিল বাপ বেটার, সঙ্গে দুপুর আর রাতে পুজো কমিটি থেকে বরাদ্দ ফ্রি ভোগের প্রসাদ। তাও এসব নিয়ে কোন অভিযোগ ছিল না গোপালের। বাড়িতেও বিরাট কিছু রাজভোগ কপালে জোটে না। সত্যি বলতে বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু না হলে নয় তাই, ফেনা ভাত আর আলু সিদ্ধ, না হয় পান্তা ভাত আর পেয়াজ। এসব ওর গা সওয়া হয়ে গেছে। জনম ইস্তক এর থেকে বেশি কিছু ভাগ্যে জোটেনি।

ছেলেকে মিথ্যে সান্ত্বনা শোনানোর পর থেকেই মানিকের মনটা ভারি হয়ে আছে। ভাল করে ছেলের মুখের দিকে তাকাতেও কষ্ট হচ্ছে। গোপালের বয়সী ছেলেরা সব রংবেরঙের নতুন জামা পড়ে প্রজাপতির মতন ডানা মেলে যেন উড়ে বেড়াচ্ছে মন্ডপের চারপাশে। ছোট্ট ছেলেটা আনমনে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে, কিন্তু হাতের কাঁসরে লাঠির বাড়ি দিতে হাত থামছে না একবারও। একটু রাত হতেই ক্লান্ত ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছিল ওদের অস্থায়ী আস্তানার একটা বেঞ্চের উপর। ঘুমন্ত ছেলেটার মাথায় খানিক হাত বুলিয়ে দিল মানিক। গোপাল কি বুঝতে পারছে যে বাবা তাকে কেবল মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে। না হলে কই আর তো একবারও ওই কথা তুলল না। চোখের কোন দুটো জলে ভিজে গেল মানিকের। হাতের তালুতে চোখ মুছে বাইরে এসে দাঁড়াল হতভাগ্য বাপ।

রাত দেড়টায় সন্ধিপুজো। মানিক ঢাক হাতে এসে দাঁড়াল পূজা স্থানে। পুরোহিতের মন্ত্র উচ্চারণ এর ফাঁকে ফাঁকে তাল দিতে থাকলো ঢাকে। ইচ্ছে করেই আর ডাকেনি ঘুমন্ত ছেলেটাকে। জড়োসড়ো হয়ে বেঞ্চে ঘুমিয়ে আছে সে। মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়ে এসেছে মুখ পর্যন্ত। মায়া জড়ানো ঘুমন্ত ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে আর জাগাতে মন চায়নি। মনে মনে নিজেকে বড় পাপী মনে হয়, বাপ হয়ে ঐটুকু ছেলেটার শৈশবটুকু কেড়ে নেবার অপরাধে-

হঠাৎ কর্মকর্তাদের একজনের হাঁক ডাকে সম্বিত ফেরে মানিকের। ঘুমন্ত ছেলেটাকে সে হিড়হিড় করে টানতে টানতে এনে দাঁড় করিয়ে দিলো কাঁসর হাতে। এ্যাঃ, পয়সার বেলায় তো এক টাকা ও তো কম নিবিনা, তা এত ঘুম কিসের। এখনই বাজা জোরে জোরে।

রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য মানিক দ্বিগুন জোরে কাঠি দিতে থাকে ঢাকে। যেন কাঠিগুলো ঢাকে নয় ওই কর্মকর্তার পিঠে বসাচ্ছে সে। ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে গোপাল, কিন্তু বন্ধ হয়নি ওর কাঁসরঘন্টা। অসহায় বাপ অতিকষ্টে সংবরণ করে চোখের জল।

দশমী পার হয়ে আজ একাদশী পড়ল। মন্ডপের সমস্ত প্রতিমা বিসর্জন সম্পূর্ণ। মানিকদের এখন সময় পাওনা গন্ডা বুঝে নেবার। কমিটির লোকজন কথামতো ওর পয়সা কড়ি সবই মিটিয়ে দিল। গোল বাঁধলো কেবল গোপালের মজুরি নিয়ে। মানিক আশা করেছিল বায়নার অতিরিক্ত কিছু টাকা অবশ্যই বকশিশ হিসাবে পাবে কমিটির লোকের কাছে। অন্তত গোপালের মুখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চয়ই ওরা অরাজি হবে না। বাড়তি টাকা কটা পেলে ছেলেটার জন্য একটা সস্তার জামা-জুতো দেখবে যদি কিনতে পারে। কিন্তু বকশিশ তো দূরস্থান, গোপালের মজুরিটাও পুরো দিতে অস্বীকার করছে ওরা। গোপাল নাকি কোনো কাজই করেনি। সারাদিন কেবল খেয়েছে আর ঘুমিয়েছে। বহু অনুরোধেও চিড়ে ভেজাতে পারল না মানিক। একবার ক্যাশিয়ারের হাতে-পায়ে ধরে, আর একবার সেক্রেটারি পায়ে পড়েও কোন লাভ হল না। দূরে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করছে গোপাল। ধীরে ধীরে পাশে এসে বাবার হাত ধরে আলতো টান দিল গোপাল।

-বাপ ঘর কে চল।

-দাঁড়া বাবা আর একটু দেখি। চল এখানের বাড়িগুলোতে ঢাক বাজায়ে দেখি যদি আরো কিছু পয়সা পাই।

-না আর দেখতি হবে না। তুই ঘর চল। আমি আর কখনো তোকে শহরের পুজো দেখাতে বলবো না।

-কিন্তু তোর জামা জুতো? ওটা তো কিনতেই হবে।

চেয়ে দেখ বাপ, আমার জামাটা তো এখনো ছিঁড়ে নাই। কুসুমপুরের পূজো দেখতে তো নতুন জামা লাগে না। আমাদের গ্রামের পূজো ঢের ভালো এই শহরের থেকে।

দুই হাতে ছেলেকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে মানিক। ওর ছোট্ট ছেলেটা এই চারদিনের অনেক বড় হয়ে গেল শহরে এসে। এবারের পুজোয় এটাই ওর বখশিস।।

 
 
 

Comments


bottom of page