top of page

বিচিত্রা সাহা - অমল আলো

ক্লাস সিক্সের অ্যডমিশন টেস্ট চলছে। বেশ বড়ো একটা ক্লাসরুম। এক একটি বেঞ্চে এক একজন ছাত্রী বসে আছে। বিভিন্ন প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রীরা এসেছে পরীক্ষা দিতে। বেশিরভাগই অচেনা। তাই বেশ একটু অন্যরকম অচেনা পরিবেশ। একটু ভয় ভয় করছে। আর সেইসময় ডি ভি গার্লস এর সিক্সের অ্যডমিশন টেস্ট বেশ কড়া টাইপের হতো। এমনসময় একজন দিদি প্রবেশ‌ করলেন ক্লাসরুমে। ওনার পোষাক ও চলনে যেন আভিজাত্য ঝরে পড়ছে। এক লহমায় সমীহ আদায় করে নিলেন। আজও মনে পরে ইনভিজিলেশন করতে করতে উনি যখন পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন ওনার পাটভাঙা শাড়ীর আর পায়ের পাম্পশু জুতোর মিলিত মচমচ আওয়াজ আমাকে সম্মোহিত করে ফেলেছিল প্রথম দিনেই। ওনার কাছে পড়তে পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয় নি, কারন উনি উঁচু ক্লাসে ইংরাজি পড়াতেন বলে পরে শুনেছি। কিন্তু আমরা বড়ো হতে হতে ওনার অবসর হয়ে গিয়েছিল।

প্রথম দিন হাইস্কুলে ঢুকতেই যে বিশাল হলঘর টা আছে সেখানে দেখি কতো কতো মেয়ে লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। এতো স্টুডেন্টস ! প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে যেন মহাসমুদ্রে এসে পড়লাম।জানলাম একে বলে এসেম্বলি হল। এখন এসেম্বলি হবে। আমরাও আমাদের নির্দিষ্ট লাইনে দাঁড়ালাম। সামনে কয়েকজন উঁচু ক্লাসের দিদি সুন্দর করে গান গাইছে আর বাকিরা তাদের সাথে গলা মিলাচ্ছে। তারপর দিনের উল্লেখযোগ্য খবর পাঠ, কিছু বক্তব্য ইত্যাদির পরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হোল নির্দিষ্ট শ্রেনীকক্ষে।

পিছনের পুরোনো বিল্ডিং এ সিক্স সেভেনে র ক্লাস হতো। প্রতিটি ক্লাসের তিনটি করে সেক্সন ছিল বাংলা মাধ্যমের আর দুটি সেক্সন ছিল হিন্দি মাধ্যমের। এই স্কুল ছিল তখন চিত্তরঞ্জনের সেরা স্কুল। একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণীতে ইংরেজি মাধ্যমেও পড়ার ব্যাবস্থা ছিল।

তুমুল খেলা চলছে পিছন দিকের ছোট মাঠে। লক এন্ড কি। আমরা‌ তখন ক্লাস সিক্স। কয়েকদিন হলো হাইস্কুল-এ এসেছি। ক্লাসে সেই সময় কোন টিচার আসেননি। হয়তো তিনি সেদিন ছুটিতে। প্রথম দুটো পিরিয়ড শেষ হয়েছে। আমরা কিছুক্ষন অপেক্ষা করে তুমুল হর্ষে খেলা শুরু করেছি। হঠাৎ দেখি সারা স্কুল একদম থমথমে, নিশ্চুপ। কারণ- পুরোন আর নতুন বিল্ডিংএর সংযোগকারি ছোট গেটের মুখে প্রিন্সিপাল স্যার। এক ছুটে হুরমুড়িয়ে সবাই ক্লাসে। টিফিন আওয়ার্স ছাড়া যে এরকম মাঠে গিয়ে খেলা যায় না আমাদের মাথাতেই নেই। প্রাইমারি স্কুল থেকে সদ্য সদ্য এসেছি। বড়ো স্কুলের রকম সকম তখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। আমরা প্রচন্ড টেনসন নিয়ে অপেক্ষা করছি প্রিন্সিপাল স্যার এসে না জানি কি কঠিন শাস্তি আমাদের দেবেন। উনি ক্লাসে ঢুকলেন, আমাদের জিজ্ঞেস করলেন কার ক্লাস? শান্ত হয়ে বসতে বলে উনি কিন্তু বেড়িয়ে গেলেন। ওনার উপস্থিতিই আমাদের চুপ করিয়ে দিল।

তখন ক্লাস রুটিন এমন হয়েছিল যারা এগারো -বারো ক্লাসে পড়াতেন তারাই আমাদের সিক্সের ক্লাস নিতেন। হয়তো ছোট থেকেই আমাদের ভিত যাতে মজবুত হয় তাই এই ব্যাবস্থা। অধিকারী স্যার যিনি এইচ এস সেকসনের অঙ্ক টিচার ছিলেন তিনিই আমাদের অঙ্ক নিতেন। খুবই অমায়িক দিলদরিয়া ছিলেন। আমাদের মতো ছোটদের বকা বা শাসন করার কথা ভাবতেই পারতেন না। স্বাভাবিক ভাবে প্রায়সঃই তিনি ইলেভেন টুয়েলভের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকতেন। এসময় আমাদের ক্লাসে আসতে তার দেরি হতো। এইরকম একদিন স্যর আসেন নি ভেবে, ক্লাসের মধ্যেই প্রচন্ড কলরবে - এলোটিং বেলোটিং সই লো খেলা চলছে, আমরা কেউ লক্ষ্যই করিনি স্যার কখন ক্লাসে ঢুকেছেন। স্যার হন্তদন্ত হয়ে এসেই পুরো ক্লাসের সব ছাত্রীকে নীলডাউন করিয়ে দিলেন। তবে নিজের আসনে ফিরে গিয়েই ওনার মনে হলো এরা এতোই ছোট যে এদের শাস্তি দেওয়াও চলে‌ না। তাই দু'মিনিটও‌ হলো না, উনি আবার সবাই কে বেঞ্চে বসতে বললেন। আমরাও পরম আনন্দে জায়গায় ফিরে গেলাম।

এরকম হাসতে খেলতে বড়ো হচ্ছি। তখন আমরা ক্লাস এইট। দুষ্টুমির ধরন আরো উন্নত হয়েছে। এমনকি অপছন্দের সিনিয়র দিদিদের পিছনে লাগতেও শুরু করেছি। একাদশ শ্রেনীতে ইংরেজি মাধ্যমে অন্য স্কুলের ছাত্রীরা অনেকেই ভর্তি হতো। তাদর চালচলন ধরন ধারন আমাদের স্কুলের সাথে তো সবসময় খাপ খেতো না। অনেকেই ছিল অতিরিক্ত উন্নাসিক। তাদের আমাদের পছন্দ হতো না। সেবছর সেরকম একজন দিদি আমাদের হিট লিস্টে। তাকে কিভাবে উত্যক্ত করা যায় তার নানা ফন্দি ফিকির ভাবা হচ্ছে। একদিন কাকলি একটা হুইসেল যোগার করে নিয়ে এলো শুধু ওর কানের কাছে বাজাবে বলে। টিফিন আওয়ার্স এ ও ক্লাসের বাইরে আসতেই ওদের দলটার সাথে ঘুরে ঘুরে ও বাজাতে লাগলো। উত্যক্ত হয়ে ওরা রুমের ভিতরে ঢুকে পড়লে ও ক্লাসরুমের বাইরে থেকেই বাজাতে লাগলো। ‌টিফিন আওয়ার্স শেষ হলে আমরা সবাই নিজেদের রুমে ফিরে এলেও কাকলি এলো না। ফিফ্থ পিরিয়ডে ভারতীদি ক্লাস নিতে চলে এলেন। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বময়ী, ওনার পড়ানো খুব পছন্দ করি। যথেষ্ট সমীহ করি সবাই। ক্লাসে পিনড্রপ সাইলেন্স। এমন সময় কাকলি ছুটতে ছুটতে হুইসেল বাজাতে বাজাতে ক্লাসে আসছে। ক্লাসের ভিতর থেকে আমরা ওকে এলার্ট করবো সেটাও পারছি না। ক্লাসরুমের দরজায় এসেই ও হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ভিতরে আসবে কিনা পারমিশন নিতেও ভুলে গেছে। আমরা সবাই ভয়ে ভয়ে ভাবছি এবারে ও প্রচন্ড বকা খাবে। কিন্তু ওর ভাবগতিক দেখে দিদিই হেসে ফেললেন,আর কাকলিও একমুখ হেসে বললো ভিতরে আসতে পারি দিদি? আমরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এরকম কতো যে কান্ড, বলত গেলে শেষ হবে না।

আমার স্কুল, আমার অত্যন্ত গর্বের জায়গা। শুধু যে দুষ্টুমি করেছি তা তো নয়, এই স্কুলে শিখেছি নানা কিছু। এতো ভালো পড়ানো হতো যে, কিছু বিষয় স্কুলেই তৈরি হয়ে যেতো। স্কুলের প্রতিটি অনুষ্ঠান এতো ভালো লাগতো ভুলতে পারি না। পুজোর ছুটির আগেই হতো বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। মহিষাসুরমর্দিনী বা দেবী দুর্গার আরাধনা, কখনো বা রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য মঞ্চে উপস্থাপিত হত অত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে। মহড়া চলতো প্রায় একমাস ধরে উপরের লাইব্রেরী রুমে। সেখানে লুকিয়ে লুকিয়ে অংক বা ফিজিক্স ক্লাসের সিরিয়াস দিদিমনির নাচ দেখে ফেলার সুযোগ যেমন হয়েছে, তেমনি কোন দিদিমনির অপূর্ব গানের গলায় মুগ্ধ হয়েছি। এখনো মনে পড়ে উঁচু ক্লাসের ইন্দ্রানীদির রবীন্দ্র সংগীত আর সুদেষ্ণাদির নজরুল গীতি। আভাদি, হ্যাপিদি, ভাস্বতীদি ভারী সুন্দর নাচ করতো। এই তালিকায় আরো অনেক অনেক নাম রয়েছে। দেবী দুর্গারূপী বন্ধু মধুমিতার নাচ এখনো ভুলতে পারিনি। অনুষ্ঠানের দিন আলোতে বাজনায় এমন সুন্দর পরিবেশ তৈরি হতো যে মনে হতো সত্যিই দেবী দুর্গার মর্তে আগমন ঘটেছে। পুরস্কার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এত উচ্চমানের অনুষ্ঠান দেখতে পাওয়ার সুযোগ পেতাম বলে আনন্দ আরো বেড়ে যেত। চিত্তরঞ্জনের সর্বাংশে সেরা মেয়েরা অত্যন্ত মনমুগ্ধকর অনুষ্ঠান পরিবেশন করতো। তেমনি প্রায় পুরো জানুয়ারি মাস ধরে চলতো বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মহড়া। সন্ধ্যাদি, অঞ্জলীদি নানারকম ড্রিল শেখাতেন। তাদের পরিচালনায় আমাদের স্কুলের মার্চপাস্ট খুব ভালো মানের হতো আর স্কুলের সমস্ত ছাত্রী তাতে অংশগ্রহণ করতো।

সরস্বতী পূজার কথা তো বলাই বাহুল্য। চিত্তরঞ্জনের সেরা পুজো ডি ভি গার্লস এর সরস্বতী পূজা। এখনো তা অব্যাহত। এত সুন্দর আলপনা আর প্রতিমা সাজানো আর কোথাও দেখা যায় না। সত্যি সর্বশেষ্ঠ। আমাদের সময়ে শ্রদ্ধেয় মৈত্রেয়ীদির পরিচালানায় ক্লাস টেন ইলেভেনের মেয়েরা হলঘরের মেঝে জুড়ে আলপনা দিত। মোনালিসা আর অলকা এতো সুন্দর আঁকতো বলার নয়।

এই পরম্পরা এখনো চলছে। ছাত্রী সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। কমেছে স্কুলের শিক্ষক সংখ্যাও‌। সরস্বতী পুজোর আলপনাও হয়তো বহরে ছোট হয়েছে- কিন্তু এখনো অবধি মাধ্যমিক - উচ্চ মাধ্যমিকে পাশের হারে ও সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তিতে এই অঞ্চলে অগ্রগন্য। আমরা যখন ছাত্রী ছিলাম, গৌরবের স্বর্ণশিখরে ছিল তার অবস্থান। এখানকার বহু কৃতি ছাত্রী দিকে দিকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত।

আজ তার ক্ষীনতনু, কালের পরিহাস হয়ে শুধুই বেদনা দেয়। এই স্কুলের ইতিহাসের পাতায় পাতায় আরো কতো যে ঘটনা রয়েছে কিছু ই বলা হলোনা। একটুখানি পরশ শুধু রেখে গেলাম।


 
 
 

Comments


bottom of page