top of page

শুভ্রা সরকার - একটা প্রেমের গল্প

আজ যখন লিখবো বলে কলম ধরলাম দেখি মাথার ভেতরটা যেন নিরেট হয়ে রয়েছে। কিছুই যে বের হচ্ছেনা করি টা কি! হঠাৎ টিভির একটা বিজ্ঞাপন যেন বিদ্যুতের রেখা হয়ে আলো দেখালো।

আজ সকালেই মর্নিং ওয়াকের সময় টকিংটা বেশ জব্বর হয়েছে। রোজ সকালে ঘন্টাখানেক হাঁটা ও এক্সারসাইজ করার পর ঘর্মাক্ত শরীরে পার্কের বেঞ্চে বসি একটু হাওয়ায় জিরিয়ে নিতে। ওয়াকিং এর চাইতেও বেঞ্চে বসে আড্ডা মারাটা আমায় আর আমার সঙ্গে আরও কয়েকজনকে বেশী টানে। কি থাকেনা সেখানে, রান্না, টিভি সিরিয়াল, নিজস্ব অভিজ্ঞতার গল্প কতকিছু। যখন ঘরে ফিরি মনে হয় যেন সঞ্জিবনী বুটি উদরস্থ করে এসেছি। সারাদিনের কাজের মধ্যে কথাগুলো ঘুরে ফিরে মনে পড়ে। মনে মনে নিজেই হেসে ফেলি। একঘেয়েমির থেকে একটু অবকাশ মেলে আর কি!

আজ বেঞ্চে বসার মিনিট খানেক বাদেই দেখি একটা ছেলে আর মেয়ে আমাদের থেকে খানিক তফাতে, বেশ কাছাকাছি বসল। একটু হাসাহাসি, ফিসফাস। আড়চোখে দেখে রিঙ্কু বৌদি বলল দেখেছো কান্ড, এই সাপ-নেউল দুটো এত কাছাকাছি! তাও, আবার গুজগুজ, ফিসফাস করছে, ব্যাপারটা কিরকম হলো! মিনতি বৌদি হেসে হেসে ফেলে বললো, আচ্ছা আসল ব্যাপারটা এখনও জানো না? ওরা হল জানে দুশমন ফ্যামিলির। মা বাবাদের সামনে ঝগড়া করে। আর পার্কে বা অন্য অনেক জায়গাতেই ওদেরকে একসাথে দেখা যায়। এই প্রসঙ্গেই প্রেম প্রসঙ্গ এলো।

রিঙ্কু বৌদি বললো, জানো, আমার ভাগ্নি ঠিক এরকমই করতো। যে ছেলেটির সাথে ভাগ্নি ঘুরত তাদের ভাগ্নি বাড়ির কেউ পছন্দ করতনা। ভাগ্নি মিনু ছিলো খুব সুন্দরী।অনেক সন্মন্ধ আসছিলো। লোকে পছন্দ করেও পরে বলত অনিবার্য কারণ বশত বিয়ে হওয়াটা সম্ভব নয়।

খোলসা করে পাত্রপক্ষ কিছু বলতনা। কিন্তু প্রেম হল ছাইচাপা আগুন। ফুলকি তো একটু আধটু নজরে পড়বেই। একদিন মিনুর দাদার চোখে পড়ল ব্যাপারটা। ব্যাস কথা চালাচালি করে মিনুর দিদির দেওরের সাথে মিনুর বিয়ে ফিক্স হয়ে গেলো। বিয়ের দিনচারেক আগে মিনুকে নিয়ে মিনুর বাবা সপরিবারে কলকাতা যাত্রা করলেন।বিয়ে হবে কলকাতাতেই। মিনুর বেরোনো বন্ধ। সে বেচারি মুখ শুকিয়ে ঘরে। দেখতে দেখতে যাওয়ার দিন এসে গেলো। একটা অ্যাম্বাস্যাডার ভাড়া করা হয়েছে। ভোররাত্রে গাড়ি আসতেই গাড়ির পেটে,মাথায় বাক্সপ্যাটরা উঠিয়ে মিনুর বাবা সপরিবারে আসানসোল স্টেশনের উদ্দ্যেশে রওনা দিলেন বিধান এক্সপ্রেস ধরবেন বলে। গাড়িটা মিনিট দশেক যাওয়ার পরেই দেখা দিলো গেরো। আরে এতগুলো বাঁশ রাস্তার উপর আড়াআড়ি ফেলে রাখা।মিনুর বাবা গজগজ করতে করতে বললেন,শুভ কাজের শুরুতেই ব্যাগড়া। মিনুর দাদাকে বললেন, " যা তো পিন্টু, ড্রাইভারের সাথে হাত লাগিয়ে বাঁশটা সরিয়ে ফেল"। অগত্যা পিন্টু ড্রাইভারের সাথে নেমে বাঁশ সরাতে ব্যাস্ত। বাবাও বেরিয়ে একটু সিগারেটে সুখটান দিচ্ছেন। যদিও একটু বিরক্ত তিনি। বাঁশের উল্টোদিকেও একটা সাদা অ্যাম্বাস্যাডার একটু আলো আঁধারিতে দাঁড়ানো। বোঝা যাচ্ছেনা লোক আছে কি নেই। দুটো বাঁশ সরানো হয়েছে বোধহয়, উল্টোদিকের গাড়ি স্টার্ট নিলো। পিন্টু চেঁচিয়ে বললো, "গাড়ির দরজা খোলা ভাই, বন্ধ করো"। হঠাৎ তীর গতিতে কেউ পাশ দিয়ে দৌড়ে উল্টোদিকের গাড়িতে উঠতেই দরজা বন্ধ। ব্যাপারটা কি বোঝার আগেই গাড়ি ফুল স্পীডে ভাগলবা। হায় হায় করে উঠলেন মিনুর বাবা, আরে আমাদের মিনু তো পালালো। গালিগালাজ করতে করতে গাড়ির আর সকলেই হাত লাগালো বাঁশ সরাতে। মিনুকে ধরতেই হবে। বাঁশ সরিয়ে গাড়ি যখন মেন রোডে পৌঁছোলো, অন্য গাড়ির কোনও হদিশই মিললোনা। তাও আসানসোল স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি চললো। কিন্তু মেয়ে গায়েব। আর একটু বেলা বাড়তেই চেনাজানা সবাই বেরিয়ে পড়লো। যেন সার্চ পার্টি। কয়েকজন মুরুব্বি গোছের লোক নিয়ে যখন মিনুর বাবা সেই অপদার্থ, আকাট, যে ছেলেকে মিনু পছন্দ করত, তাদের বাড়ি পৌঁছোলেন, দেখলেন বাড়ির বাইরে মস্ত তালা।

গেলো কোথায়? পুলিশ স্টেশন বাদ ছিলো। এবার সেখানেই হানা। পুলিশ মেয়ের বয়স জেনে বললো, মেয়ে যখন স্বেচ্ছায় গেছে তখন কিছু করার নেই। মেয়ে সাবালিকা। আর কিডন্যাপ কেস ও তো নয়।

এবার বাকী গল্প টা মনুর কাছেই শোনা রিঙ্কু বৌদির। মিনু কাজের মেয়েকে দিয়ে বাবার তথাকথিত অপদার্থ ছেলের বাড়িতে খবর পাঠিয়েছিলো যে, রোববার ভোর রাতে বিধান ধরতে যাবে, কারণ বিয়ে ঠিক, কিছু করার থাকলে তাড়াতাড়ি তা করতে হবে। ছেলের মা সব শোনার পর বলেছিলো ওই ঘোষের পোর বড় বাড় বাড়ছে, আমরা গঙ্গোপাধ্যায় হইয়াও মাইয়াডারে বাড়ি আনতে চাইছি বৌ কইরা আর ওই হালার পো তারে লইয়া যাইবে অন্যত্র বিয়া করাইতে। ঠিক আছে এবার দেখাইতেছি এই বামনী কি করতে পারে। ওনার বুদ্ধিতেই বাঁশ ফেলে গাড়ি দাঁড় করানো হয়। তারপর মিনু সহ সপরিবারে কল্যানেশ্বরী, সেখানেই বিয়ে। ফেরার পথে পুলিশ থানায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে মিনু আর তার বরকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, এই হইল আমার বৌমা, সে স্বইচ্ছায় আমার পোলারে বিয়া করছে। খবর পাইছি ঘোষের পোলাটাও আইছিলো এখানে কমপ্লেন লিখাইতে। অরেই জিগান আমরা অরে জোর করছি না ও নিজেই আমাগো সঙ্গে আইছিলো। মিনুর শ্বাশুড়ি ছিলেন সি পি এমের নেত্রী। দারোগা সাহেব ও আর বেশী ঘাঁটান নি। তিনিও নির্ভীক চাঁছাছোলা নেত্রীকে ভালোই চিনতেন। বললেন, ঠিক আছে, নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে নিন। বিয়ের দুদিন পর অনেক তোড়জোড়, হৈ হল্লা করে মিনুর বৌভাত হল। মিনুর বাপের বাড়িতেও নেমন্তন্ন করা হয়েছিলো। মিনুর বাবা নেমন্তন্ন করতে আসা দেওরকে বলেছিলেন, এই বিয়া আমি মানিনা। মিনু মইরা গেছে। এই হারামজাদা পোলা আমাগো বাড়ি আইলে পিডাইয়াই আমি ওরে মাইরা ফেলামু।

তা অকে আর মিনুর বাবা পিটানোর সুযোগ পাননি। নাতি হওয়ার পর দজ্জাল শ্বশুড়ের ভুমিকা থেকে স্নেহপ্রবণ দাদুর ভুমিকায় অবতীর্ণ হওয়াই শ্রেয় মনে করলেন। এখন দুই বাঙাল বেয়াই বেয়ানের বড় ভাব।

 
 
 

Comments


bottom of page