top of page

অমল আলো

বিচিত্রা সাহা


আমাদের ট্যাক্সিটা ময়দান এলাকায় আসতেই যানজটের কবলে পড়ল। বিরাট মিছিল চলেছে। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ১৪০০ বঙ্গাব্দ। এক শতাব্দী শেষে পৌঁছে যাওয়া আরো একটি নতুন শতাব্দীতে। যেন এক যুগ সন্ধিক্ষণে, কালের হাত ধরে এগিয়ে চলা এই পৃথিবীর বুকে। উৎসবপ্রিয় হুজুগে বাঙ্গালীর কি উন্মাদনা! ১৪০০ শতাব্দীকে বরণ করে নিতে সেবার কতো আয়োজন! পয়লা বৈশাখে র ভোরে দিকে দিকে ধ্বনিত হলো মঙ্গল শঙ্খ। কলকাতার রাস্তায় নেমেছে নারী পুরুষের ‌ঢল।

'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি', 'ও আমার দেশের মাটি, তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা', 'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী', রবিঠাকুরের গানে গানে চলেছে বাংলার জয়গান।

কি অপরূপ সে সকাল! সকলের পরণে লাল পাড় সাদা শাড়ি, কিম্বা সাদা পাঞ্জাবি। বৈশাখের স্নিগ্ধ ভোর আমোদিত হচ্ছে বেল, যুঁই ফুলের মালার সুবাসে। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!

কি ভাগ্যি সেদিন আমি বাড়ী ফিরছি। কলকাতার একটি বি এড্ কলেজের ছাত্রী তখন আমি। পূর্বা এক্সপ্রেস ধরতে হাওড়া স্টেশনে যাচ্ছি। তাই সকাল বেলার সেই শোভাযাত্রা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সারাবছর বাংলা তারিখ নাই বা মনে রাখতে পারলাম, বছর শুরুর দিনটা বাঙালিয়ানায় মেতে উঠতে কিন্তু বেশ লাগে। সাবেকি জিনিস গুলো অন্তত এই উপলক্ষ্যে একদিনের জন্য হলেও কদর পায়।

তখন দূরদর্শনের 'বৈঠকি' অনুষ্ঠানে আসতেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর গলায় পুরাতনী গান শোনার মেজাজই আলাদা।

কলেজে, হোস্টেলের ছাদে আমরাও করেছি নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠান। মনে পড়ছে সমবেত কন্ঠে আমাদের গেয়ে ওঠা – ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুঁইয়ে দাও’, ‘নব আনন্দে জাগো আজি’ …

সত্যি আমরা সে সময় আনন্দেই বাঁচতাম। মনে পড়ে আরো ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখ মানেই যেন কোন উৎসব। সকাল সকাল স্নান সেরে নতুন জামা পড়ে গুরুজনদের প্রণাম করে চলে যেতাম কাকুর দোকানে। আমলাদহি বাজারে তখন আমার কাকুর রেডিমেড জামাকাপড়ের একটা দোকান‌ ছিল। আমি আর মিঠুল সকালে ফুল বেলপাতা নিয়ে পৌঁছে যেতাম দোকানে। ওখানে হালখাতা র পুজো হত। পুজো শেষে প্রসাদ নিয়ে বাড়ী ফিরতাম।

এরকম একবার পয়লা বৈশাখে পুজো শেষে কাকুর সাথে চলেছি কাকুর বাড়িতে। কাকু তখন থাকতেন কল্যানগ্ৰামে, একটা ভাড়া বাড়ীতে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে হঠাৎ করে। তখন কল্যানগ্ৰামে যাওয়ার রাস্তাই তৈরী হয় নি। তুমুল বৃষ্টি তে মাঠের লাল মাটি, কাঁদাগোলা হয়ে বয়ে চলেছে খলবল করে। কোনখানে গর্ত কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমরা প্রায় হাবুডুবু খেতে খেতে বৃষ্টিতে ভিজে পুরো একশেষ হয়ে অবশেষে পৌঁছালাম। কাকু আবার মাংস কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। অতএব আবার স্নান করে গরম গরম মাংস ভাত।

সন্ধ্যা বেলা বাপী র সাথে বেরোতাম হালখাতা করতে। প্রচুর দোকান থেকে রাশি রাশি মিষ্টির প্যাকেট আর বাংলা ক্যালেন্ডার নিয়ে ফিরতাম। বাংলা ক্যালেন্ডার নিয়ে কোন উন্মাদনা ছিল না আমাদের। একটা বা দুটো দেওয়ালে ঝোলানো হোত। কিন্তু কোন দোকান থেকে কেমন প্যাকেট এল তা নিয়ে উত্তেজনার শেষ ছিল না। তবে গজা, লাড্ডু আর তিনকোনা চ্যাপ্টা নিমকি থাকতো প্রায় সব প্যাকেটেই। চমচম বা আরো কিছু হাবিজাবি মিষ্টি থাকতো। কিন্তু ওগুলো তেই আমরা খুব খুশি হতাম। আর ঐ নিমকি ছিল একেবারেই নববর্ষ স্পেশাল। তারপর সারাবছর কোথায় হাওয়া হয়ে যেত কে জানে?

দেখতে দেখতে পেড়িয়ে এলাম অনেক গুলো বছর। এখন বড়ো হওয়ার সাথে সাথে এসব চল উঠতে উঠতে প্রায় উঠেই গেছে। কিন্তু, জীবন তো অন্য খাতে বইতে থাকে সময়ের সাথে। এখন নববর্ষে নতুন শাড়ি পড়ে পাঠচক্রে যাওয়ার চেষ্টা করি ঠাকুর প্রণাম করতে। এবার নতুন বছর ১৪২৮ শুরু হচ্ছে আমাদের হিলটপের তৃতীয় সংখ্যা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সবাই সৃষ্টিতে থাকুন, ভালো থাকুন। পৃথিবী আবার ফিরে আসুক তার চেনা ছন্দে।



 
 
 

Comments


bottom of page