top of page

নতুন বছরের গল্প

অমিতাভ রায়

চুলোয় যাক সব ভদ্রতা। আজ এর শেষ দেখে তবেই ছাড়বে রিঙ্কু। আরে ভেবেছে কি লোকটা! পুরুষ মানুষ বলে যা খুশি তাই করবে। না হয় রিঙ্কু ডিভোর্সি, রিঙ্কু একলা থাকে, রাত হয় চাকরী থেকে ফিরতে, রোজ রাতে পেরোতে হয় এক প্রায়ন্ধকার গলি, তাই বলে, পিছু নেবে লোকটা রোজ রাতে?

এই পঁয়তিরিশ বছর বয়সেই দুনিয়ার ওপরে ক্ষেপে থাকে সে। পুরুষ নারী সব সমান। কাকে ছেড়ে কার কথা বলবে? ভালোবেসে বিয়ে তো করেছিলো অম্বরকে। ছোট্ট ফ্ল্যাটকে স্বর্গ বানিয়ে তুলেছিলো। দুজনের অফিস শেষে কফি খেতে চলে যাওয়া, কখনো তুমুল বৃষ্টিতে ইচ্ছে করে ভিজে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া

"জলে-ডোবা চিকন শ্যামল কচি ধানের পাশে পাশে

ভরা নদীর ধারে ধারে হাঁসগুলি আজ সারে সারে

দুলে দুলে ওই-যে ভাসে।"

কখনো ঝগড়া শেষে অভিমানের জল চোখে ঘুমিয়ে পড়া রিঙ্কুকে মাঝরাতে উদোম আদরে ভরিয়ে দেওয়া-- উফফ। অম্বরের উষ্ণ বুকে পাখির মতো গুঁজে দিতো নিজেকে রিঙ্কু। অম্বরের আদরে গলে যেত আইসক্রিমের মতো। কেমন অদ্ভুত ভাবে বদলে গেল অম্বর। তার হাত আর সেতার হয়ে বাজছিল না রিঙ্কুর শরীরে। যন্ত্রের মতো কৃত্রিম হাসি, বোকা ভুলভাল কথা-- রিঙ্কু খুব তাড়াতাড়ি বুঝে গেলো অম্বর প্রেমে পড়েছে আবার। যাকগে ওসব কথা মনে করে আর কি হবে? আজ তিন বছর একলা থাকে সে। চাকরী করে ফ্ল্যাটে ফিরতে রাত হয়, তাই বলে কোনোদিন যা হয়নি তাই হবে? একটা লোক পিছু নেবে রোজ? বড়লোক পরিবারের সুন্দরী মেয়ে হবার জ্বালা তো সেই কলেজ জীবন থেকে পুইয়ে আসছে। শুধু অম্বর কেন? সুজিত, রাজ, মলয়, স্যার সাধনবাবু -- হাসিও পেত, মজাও লাগতো খুব। একটা ছেলে ছিল খুব মুখচোরা। অনিমেষ না কি যেন নাম। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতো তাকে। বন্ধুরা বলতো দেবীর ভক্ত। তাই-ই বটে। সে কি গভীর চাউনি! শ্রেয়া বলতো, "ওরে রিঙ্কু, হাজার পুরুষ মরলে এমন ভক্ত জন্মায়। বিয়ে করবি তো একেই কর। সকাল বেলার চা থেকে শুরু করে রাতের নাইটি পরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত কোনো চিন্তা নেই।"

ধু...ররররর! মুখ বেঁকালো নিজের মনেই রিঙ্কু। কি হলো সেই রূপ দিয়ে? অম্বরও তো রূপবান। দুজনের জুটি দেখলে প্রাণ ভরে যেত সকলের। সেই রূপ দিয়ে কি আটকে রাখা গেলো পরস্পরকে? গভীর শ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। বরং অফিসে, বাইরে রূপ নিয়ে সমস্যাই বাড়ছে রিঙ্কুর।

এই তো ফ্ল্যাটে ফেরার সময় এই লোকটা! আইটি সেক্টরে কাজ সেরে বাসে করে নামে ফ্ল্যাটের গলির মুখটাতে। গলির মুখ থেকে তার ফ্ল্যাট, বড়জোর মিনিট আটেকের রাস্তা। পরিচিত গলি। প্রায়ান্ধকার যদিও। রাত নটা তে নির্জন হয়ে যায় বই কি। আগে সে আর অম্বর দুজনে মিলে পার হত এই প্রায়ান্ধকার গলি। এই গলি টার জন্য ফ্ল্যাট নিতে আপত্তি করেছিল সে। আবার গলিটার জন্যেই ভাড়া কম ছিল সুবিধেজনক জায়গার ফ্ল্যাট টার। অথচ, বিয়ের পাঁচবছর এই গলি যেন আলোময় এক সাঁকোর মতো তাকে আশ্রয় দিতো। আজ তিন বছর সে একলাই পার করছে গলিকে। কি আসে যায়। অম্বর ছেড়ে গেলেও সে ওই ফ্ল্যাটেই আছে। বাবা মা জোকাতে থাকে। কি করবে ওখানে গিয়ে? নিজের ভালো চাকরী দিয়ে নিজেই চালিয়ে নেয় সবকিছু। বাবার সংসার এখন দাদার। সেখানে আর কি সেই স্বাধীনতা থাকে কখনো? এমনিতেই বৌদী সোহিনীর অম্বর কে ভারি পছন্দ ছিলো। তার ধারণা দোষ রিঙ্কুর। রিঙ্কুই এমন এক মহিলা যার সঙ্গে থাকা যায়না। এসব কথা মনে পড়লে বুক টা ভারী হয়ে ওঠে। এরা কি নিজের লোক? আপনজন? কেউ হয় কখনো আপনজন? আজ যার ভালোবেসে হাত ধরছো, দুদিন বাদে দেখবে সে এক অচেনা ভঙ্গী করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কম দেখলনা রিঙ্কু জীবন কে? কঠিন তাকে হতে হয়েছে। সে আর ভয় পায়না। ভীতু চড়াই ডাকত অম্বর, আজ দেখলে নির্ঘাৎ চমকে উঠতো। আজ সে হিংস্র বাজ পাখীর চেয়ে কম নয়।

গলির মুখে বাস থেকে নামলো যখন রিঙ্কু রাত ঠিক নটা দশ। চৈত্রের শেষ হালকা মৃদু বাতাস বইছে, সঙ্গে ঝির ঝিরে বৃষ্টি। সব মিলে এক থমথমে রাত। কোনো এক ফ্ল্যাটে গান বাজছে

এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে

আমি কুড়িয়ে নিয়েছি, তোমার চরণে দিয়েছি

লহো লহো করুণ করে॥”

প্রায় দৌড়ে রাস্তা টুকু পার হবার চেষ্টা করলো। মরীয়া চোখ চালালো, একজনকেও যদি দেখতে পায়। কেউ নেই। সতর্ক মন জানান দিলো কেউ তো আছে! কেউ নিঃশব্দে অনুসরণ করছে। এমন সময়ে আবার সেই ভীতু চড়াই টা ডানা ঝাপটায়। আশ্রয় চায় কারো বুকে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কাটলো সে। উদ্গত কান্না সামলে, বুকের কাছে ব্যাগ চেপে ছুটে পেরোতে চাইলো প্রায়ন্ধকার গলি টা। পেছনে দ্রুত হলো পায়ের শব্দও। ভয় একসময় সাহসী করে তোলে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে নিরীহ মানুষও ঘুরে দাঁড়ায়। রিঙ্কু দাঁড়িয়ে পড়লো আচমকা। পায়ের শব্দ যেন ঘাবড়ে গিয়ে থেমে গেলো। অন্ধকার, টিপ টিপ বৃষ্টি সব মাথায় নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো রিঙ্কু। হাত পাঁচেক দূরে এক ছায়ামূর্তি। আজ বেশ কয়েকদিন হলো তাকে ফলো করছে। কত আর পালাবে রিঙ্কু? কার কার থেকে পালাবে? সমাজ? সংসার? আত্মীয় স্বজন? দরকার নেই পালানোর। বরং ঘুরে দাঁড়াক। বাঁচা মরা কিছু একটা হেস্ত নেস্ত হোক তবে আজ। ঘুরে সোজা দাঁড়িয়ে রইলো সে। একমিনিট। দু মিনিট? না হিসেব নেই। ছায়ামূর্তি একটু যেন দোনামোনা করে এগিয়ে এলো। টর্চ জ্বালালো। চোখ টা একটু ধাঁধিয়ে গেলো রিঙ্কুর। এ কে তার সামনে দাঁড়িয়ে? খুব চেনা তো এ? কিন্তু আবার মনেও পড়ছে না ঠিক করে। কে যেন?

কথা বলে উঠলো সেই ছায়া "চমকে উঠবে জানতাম। সামনে আসার সাহস কোনোদিন-ই ছিল না। আজও নেই। কিন্তু অম্বর চলে গেছে। তুমি একলা। আমি মানতে পারিনি। খবর টা শোনার পর থেকে অদ্ভুত কষ্ট কুরে কুরে খচ্ছে। সব খবর রাখতাম তোমার। রোজ রাত নটার সময়, গাড়ী এখানে পার্ক করে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। একলা তোমার খুব ভয় করে আমি জানি তো। আমার সব মনে আছে যে। আমি তো বোকাই রয়ে গেলাম। তাই আমার আর অম্বর হওয়া হলোনা। এক জায়গাতেই আটকে রইলাম।"

অনিমেষ! এমন হয় নাকি? এ কি সিনেমা? প্রেম এমন অদ্ভুত হয় নাকি? কুলকুলিয়ে হাসতে ইচ্ছে করলো অনেকদিন পরে। গলি টা কেমন আলোময় হয়ে উঠলো আবার। সমস্ত শরীর নির্ভার বীণা র মতো হয়ে উঠলো। সামনের ঘাবড়ে যাওয়া পুরুষটি কে ধমক দিয়ে বলে উঠলো “ব্যাগ টা ধরোতো আমার। চাবিও আছে ওর মধ্যে। চলো একটু কফি খাবো দুজনে বসে। খুব ক্লান্ত লাগছে”।

বলেই দুড়দার হাঁটা লাগলো রিঙ্কু। নিশ্চিন্তে। পিছনে দুটো পা তাকে অনুসরণ করছে জানে সে। তাই আর ভয় নেই। সে আবার সুখী চড়াই হয়ে উষ্ণতার খোঁজে মুখ লুকোতে পারবে কারো বুকে। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। জীবন বড়ো মহার্ঘ। তাকে নষ্ট হতে দিতে নেই কক্ষনো। অম্বরে ওড়া শেষ হয়েছে রিঙ্কুর। মনে হয় এবার খড়কুটো জোগাড়ের সময় হলো তার। ভারি মিষ্টি এক হাসি মুখে নিয়ে গলি পার হতে লাগলো রিঙ্কু। এমন সময় ওই ফ্ল্যাটে বেজে উঠলো

“এসো হে বৈশাখ এসো, এসো,

তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,

বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক

যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,

অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক”



 
 
 

Comments


bottom of page