top of page

ফিরে পাওয়া

বনশ্রী ভট্টাচার্য্য


-Rumela added you-

দশটা বাজে। কাজ শেষ করে এই সময় নীলা ফোনটা নিয়ে একটু বসে। আজ ফোন খুলেই মেসেজ টা দেখে মনে মনে খুব খুশী হোলো। অনেকদিন ধরেই স্কুল কলেজের বন্ধু দের কথা ভাবছিলো। কত বছর কারো সাথে যোগাযোগ নেই। সেদিন হঠাৎ রুমেলার সাথে দেখা। ওরা দুজনে একসাথে ওয়ান থেকে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত পড়েছে। তারপর নীলার বিয়ে হয়ে যায়। সেই থেকে কোনো বন্ধুর সাথেই আর দেখা হয়নি। সংসারের চাপে কখনো পুরোনো কথা সেভাবে মনেও পড়েনি।

সেদিন রুমেলা তাকে না ডাকলে রুমেলাকে চিনতেও পারতো না। প্রায় ঘন্টাখানেক রাস্তায় দাঁড়িয়েই ওদের স্মৃতিচারণ চললো। রুমেলা বলেছিলো ওদের একটা ওয়াটসআপ গ্রুপ আছে “ফিরে পাওয়া”। সেখানে রোজ কাকলি, মিত্রা, সৌমি, সুনন্দ, যুঁই, আকাশ সবাই মিলে কত গল্প হয়। রুমেলাই উদ্যোগ নিয়ে গ্রুপটা খুলেছিলো। উদ্দেশ্য সেই পুরোনো দিনে ফিরে যাওয়া। মাঝে মাঝে সবাই মিলে বেড়াতেও যায়। কখনও পরিবারের সবাই মিলে, আবার কখনও শুধুই বন্ধুরা। এসব শুনতে শুনতে নীলার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিলো। বিয়ের পর থেকে সে কেমন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। অথচ স্কুলে সে সবথেকে উচ্ছল, প্রাণবন্ত মেয়ে ছিলো। সব বন্ধুদের খুব প্রিয়। ক্লাস অফ থাকলেই সবাই মিলে তার গান শুনতে চাইতো। যে কোনো অনুষ্টানে তার ডাক পড়তো গান গাওয়ার জন্যে। খেলাধূলোতেও সে ছিলো পারদর্শী। হঠাৎ রুমেলার ডাকে তার সম্বিত ফিরে এলো। “ফোন নম্বরটা দিস নীলা। তোকে আমাদের ‘ফিরে পাওয়া’ গ্রুপের একজন করে নেবো।” শুনে নীলা আপত্তি জানিয়েছিলো। সংসারের কাজ করে সে তো এতটুকুও সময় পায়না নিজের জন্যে। ছেলে মেয়ে আর স্বামী বিজিত এর প্রয়োজন মেটাতে মেটাতে কখন দিন শেষ হয়ে যায় বুঝতেও পারেনা। তার প্রিয় হারমোনিয়ামটা যে কত বছর বন্ধ তা মনেও পড়েনা। মনে আছে বিয়ের কিছুদিন পর গান গাইতে বসেছিলো। শ্বাশুড়িমা এসে সেই যে হারমোনিয়াম বাক্সে তুলে দিলেন তারপর থেকে আর গান গাওয়া হয়না। সেদিন রাতে শ্বশুর তাকে বলেছিলেন, “কষ্ট পেয়োনা। আমি তোমার মা কে বুঝিয়ে বলবো। তুমি এত ভালো গান গাও, সেটা আমি নষ্ট হতে দেবোনা।” এ বাড়িতে শ্বশুড় মশাই একমাত্র তাকে বুঝতেন। তিনি সেদিন খাবার টেবিলে সে কথা বলেওছিলেন। কিন্তু শ্বাশুড়ির সেই এক কথা। গান বাজনা এ বাড়িতে চলবেনা। স্বামী বিজিতের মুখেও এক কথা। ছেলে মেয়ে মানুষ করো, মা বাবাকে যত্ন করো, বিয়ের পর সব মেয়েরা তাই করে।

আজ ‘ফিরে পাওয়া’ তে নিজেকে দেখে নীলা যেন সত্যি সেই পুরোনো দিন ফিরে পেলো। মনে মনে ভাবলো সবাই যখন সংসার সামলে একটু গল্প করে, আমিই বা পারবোনা কেন? সংসারকে অবহেলা না করে নিজের জন্যে একটু সময় বের করে নিলে ক্ষতি কি? এখন তো ছেলে মেয়ে আর ছোটোটি নেই। নীলা ও আজ থেকে কাজ সামলে ওদের সাথে গল্প করবে। শুধু কি গল্প! গান, কবিতা, রান্না, খেলাধুলো, সিনেমা সব কিছুই এখানে আলোচনা হয়। নীলা কয়েকদিনের মধ্যেই কত নতুন নতুন রান্না শিখে ফেলল। নীলার একটু আধটু লেখারও শখ ছিলো। বন্ধু বান্ধবীদের জন্মদিনে বা বিবাহ বার্ষিকীতে সে একটা করে কবিতা লিখে উপহার দেয়।

একটু আগে ফোনটা নিয়ে সবে বসেছে। তখনি ছেলের ডাক, “মা, খেতে দাও”। নীলা উত্তর দিলো, টেবিলে সব গোছানো আছে খেয়ে নাও। ছেলে অবাক, মায়ের হঠাৎ কি হোলো? এরকম ভাবে তো মা বলেনা। ফোনে মিত্রা আজ দারুণ একটা মিষ্টি বানানো শিখিয়েছে। নীলা সেটাই দেখছে আর ভাবছে মিষ্টিটা বানিয়ে রাতে খাবার টেবিলে সবাইকে অবাক করে দেবে। মিষ্টি খেতে এ বাড়ির সবাই ভালোবাসে। কলিং বেলের আওয়াজে নীলা উঠে দরজা খুলে দিলো। মেয়ে টিউশানি করে ফিরলো। জামা কাপড় ব্যাগ সব ছুঁড়ে ছুঁড়ে যেখানে সেখানে রাখলো। এতদিন এসব নীলাই গুছিয়েছে। আর নয়, বাচ্চাদেরও তো স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে, নিজের কাজ নিজেকে করা শিখতে হবে। মেয়েকে ডেকে নীলা বললো “সব জায়গা মতো গুছিয়ে রাখো, আর হ্যাঁ কাল থেকে এসব কাজ নিজেই করবে”। নীলা মনে মনে খুব খুশী নিজেকে একটু একটু করে বদলাতে পেরে, আর এই বদলানো তে তো ছেলেমেয়েরই ভালো হচ্ছে।

প্রতিদিনের মতো আজও সকালে কাজ সেরে নীলা ফোন নিয়ে বসেছে। আজ কাকলির জন্মদিন, নীলা শুভেচ্ছা জানাতে কবিতাটা লেখা সবে শুরু করেছে, বিজিতের ফোন। অন্যমনষ্ক হয়ে গেলে সে আবার গুছিয়ে লিখতে পারেনা। ফোনটা না ধরে লেখায় মন দিলো। পরপর তিনবার ফোন এলো, বাধ্য হয়ে ফোনটা ধরতে হোলো। বিজিতের গলা, “ফোনটা ধরছোনা কেন?” নীলা বললো “দরকারি কাজ করছি”। “বাবাঃ তোমার আবার দরকারি কাজ! কাজ মানে তো ওই রান্না বান্না। তবে কয়েকদিন হোলো দেখছি নিয়ম করে ফোন নিয়ে বসাটাও তোমার কাজ হয়েছে”।

নীলা ফোনটা কেটে দিলো। এসব কথায় তার আজকাল আর মনখারাপ হয়না। নিজেকে সময়ের উপযোগী করে তোলার আর নিজের শখগুলো পূরণ করার স্বপ্নে মেতে আছে।

“কি রে কাল আসছিস তো আমাদের রি ইউনিয়নে!” রুমেলার ফোন। নীলা কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। বিয়ের পর কখনও একা বেরোয়নি। মনে পড়ে গেলো একবার বাড়িতে কেউ ছিলোনা, দরকারি কাজে বেরোতে হয়েছিলো। উল্টো দিকের বাসে চেপে পড়েছিলো। রাস্তায় বিজিতের বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরে আসতে পেরেছিলো।

বিজিত কে বা ছেলেমেয়েকে বললে তারাও তো নিয়ে যাবেনা। কি করবে ভাবতে ভাবতে ঠিক করে ফেললো একাই যাবে।

রি ইউনিয়নে যাবার জন্যে সকাল সকাল ঘরের কাজ সেরে রান্নাঘরে ঢুকলো নীলা। বিজিত বললো “আজ আমরা বাইরে খেয়ে নেবো। তোমায় রান্না করতে হবেনা”।

এবার নীলা সাজতে বসলো। বন্ধুদের আবদার “সুন্দর করে সেজে আসবি”। নীলা বলেছিলো, এই বয়সে আর সাজ! কে দেখবে? সাজ কি শুধুই দেখাবার জন্যে? নিজের জন্যে সাজবি। মন ভালো থাকবে। সত্যি বলতে নীলা সাজগোজ করতে ভালোবাসতো। সংসারের চাপে সেসব ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই। আজ আবার অনেকদিন পরে সুন্দর করে সাজলো।

এবার এলো সেই বহু অপেক্ষার সময়। নদীর ধারে একটা বাগানবাড়িতে রি ইউনিয়ন। নীলা একাই একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলো। বাকী বন্ধুরা সবাই এসে পড়েছে। একে একে সবার সাথে দেখা হোলো। কই কেউতো এতটুকু বদলায়নি! কাউকে তো চিনতে অসুবিধে হচ্ছেনা! ওইতো মিত্রা, সেই রকম মোটাই আছে। কি রে আকাশ তুই তো সেই কাঠির মাথায় আলুসিদ্ধ ই রয়ে গেলি। আরে সুনন্দ না! মাথা তো একেবারে গড়ের মাঠ।

বন্ধুরাও এতদিন পরে নীলাকে পেয়ে খুব খুশী। রুমেলা কে দেখা যাচ্ছেনা তো! ওই তো হাতে স্ন্যাকস আর কফি নিয়ে আসছে। একদম আগের মতোই আছে, সব দিক একাই সামলে নিতে পারে। সৌমিটার সেই ছোটোবেলার স্বভাব এখনও গেলোনা। শুধু দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আর কাকলি ঠিক আগের মতোই শান্ত।

স্ন্যাকস খেয়ে সবাই মিলে বসলো জমিয়ে আড্ডা হবে। রুমেলা বলে উঠলো আমাদের আড্ডা নীলার গান দিয়ে শুরু হবে। এই না না, কত দিন গান গাইনা, পারবোনা রে গাইতে। সবাই মিলে চেপে ধরলো গাইতেই হবে। নীলার মনে পড়লো একসময় সে ছিলো ক্লাসের মধ্যমনি। গানে খেলায় জমিয়ে রাখতো। নীলা গান ধরলো, “পুরোনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে”। তারপর একের পর এক গেয়ে চললো।

গান শেষ করে পিছনে হাততালির শব্দে চমকে তাকিয়ে দেখে বিজিত, আর নীলার দুই ছেলে মেয়ে। নীলার মনের কথা বুঝতে পেরে রুমেলা বলে “আমরাই ওনাদের আসতে বলেছিলাম। তুই না বলেছিলি তোর ওয়াটসআপ এর গল্পে বাড়ির সবাই বিরক্ত। তোর এতবড়ো প্রতিভা, গান গাওয়া সেটাও নষ্ট হতে বসেছিলো। আর তোর কাছে একটা গল্প লেখা চেয়েছিলাম সেদিন সেটা আমার কর্তার অফিসের ম্যাগাজিনের জন্যে দিয়েছি। সেটা ম্যাগাজিনেও প্রকাশিত হয়েছে। আমার কর্তা আর বিজিতদা তো একই অফিসে আছেন।

“বিজিতদা তোর একটা লেখাতেই তোর ফ্যান হয়ে গেছে, তবে তুই তো অন্য নামে লিখেছিলি। উনি লেখিকার সাথে আলাপ করতে চেয়েছিলেন। মনে মনে ভেবেছিলাম, ভালোই হবে, তোর গানও শুনিয়ে দেবো।

“আমাদের এবারের রি ইউনিয়নে আমরা বন্ধুরাই শুধু থাকবো ভেবেছিলাম, তবে সবার মতামত নিয়ে আমি ওনাদের ডেকেছিলাম। তোর সাথে নতুন ভাবে পরিচয় করাবো বলে।

“কি বিজিত দা, কি ভাবছেন”?

বিজিত নীলার হাত ধরে বললেন “তোমার গুনের কদর করতে চাইনি বলে এখন খুব খারাপ লাগছে। হারিয়ে যাওয়া সময় তো আর ফেরানো যাবেনা। আমি একজন গানের টিচারের সাথে কথা বলেছি। কাল থেকে উনি আসবেন তোমাকে গান শেখাতে।“

মেয়ে একটা ডাইরি আর পেন মায়ের হাতে দিয়ে বললো “আমার স্কুলের ম্যাগাজিনের জন্যে একটা লেখা দিতে হবে।“



 
 
 

Commentaires


bottom of page