top of page

মেয়েমানুষ ছেলেমানুষ

অতনু চৌধুরী


যত হাত তত ভাত এই আপ্ত বাক্যটি জীবনের সার হিসেবে জানে বুধিরাম। শুধু বুধিরাম কেন, রানীগঞ্জ কয়লা খনি অঞ্চলের এই কুলি লাইনের প্রত্যেক বাসিন্দার ই জীবনের সারমর্ম তাই। তবে যে সে হাত হলে হবে না, হতে হবে পুত্র সন্তানের কর্মঠ হাত। কন্যা সন্তান প্রসব করা এখানে ক্ষমাহীন অপরাধ। রোজগেরে ছেলের জন্ম মানে লাভ। রোজগারের সাথে বিয়ের সময় মোটা পাওনা। আর মেয়ে মানে ক্ষতি।গাটের পয়সা খরচ করে দাও বিয়ে। জীবনের লাভ ক্ষতির অংকটা এখানে এরকমই সহজ সরল।


বস্তির প্রত্যেকেরই জীবিকা একটাই, খনির মজদুরি। তবে সরকার স্বীকৃত নয়, কন্ট্রাক্টারদের যোগান দেওয়া খনি মজুর। সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম শ্রমমুল্য বিধি সম্পর্কে সম্যক ধারণাটুকু এদের নেই। এরা কেবল জানে বয়স ১৫-১৬ হলেই ছেলেদের হাতে গাইতি বেলচা নিয়ে নেমে যেতে হবে খনি গহবরে। সারাদিন খনির দেওয়াল কেটে তুলে আনতে হবে টন টন কালো হীরা। বদলে সপ্তাহের শেষ দিনে জুটবে মালিকের দান হপ্তা। মাইনে কে এখানে হপ্তা বলাই রীতি। হাতে পাওয়া কটা টাকার খরচ হবে শুরিখানায়। রবিবার টা কাটবে রাজার মতন। তারপর সোম থেকে শনি শুধু ধার দেনা আর পাওনাদারের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচা। শিশু সন্তানকে স্কুলে পড়ানো এদের কাছে বিলাসিতা, আর কন্যা সন্তানের আলোচনা যত কম করা যায় ততই মঙ্গল। ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তাদের গর্ভচ্যুত করাটাই এখানকার দস্তুর। কারো ভুলে যদিও বা কোন কন্যা সন্তান কারো ঘরে জন্ম লাভ করে তবে নিয়ম করে প্রতি ঘন্টায় গাল গঞ্জনায় বিদ্ধ হওয়াটাই তার প্রাপ্য।


এইরকম পরিবেশে বুধিরামের স্ত্রী রানীর কোলে আসে সীতা। এর আগে রানী র পাঁচ পাঁচটি পুত্র সন্তান হয়েছে। আত্মবিশ্বাসের কারণে এবার আর পরীক্ষা করে দেখেনি বুধিরাম। তা বলে কেউ মনে করবেন না যে "জন্ম পূর্বে ভ্রুন পরীক্ষা করা অপরাধ" এই নিয়মটি কুলি লাইনের বাসিন্দাদের অজানা। তবে আইন আছে আইনের বইয়ের পাতায়। আর যেখানে নিয়ম অমান্য করাটাই নিয়ম, সেখানে ওসব মামুলি ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবে কে? বৈধ অবৈধ গর্ভপাত কেন্দ্রের ছড়াছড়ি। পয়সা ফেললেই হল, কোয়াক ডাক্তার ছুরি কাঁচি নিয়ে তৈরি। আর ক্ষতি হলেই বা কার হবে? প্রাণ তো যাবে সেই কন্যাভ্রূণ অথবা তার গর্ভধারিণীর। যেই যাক, পৃথিবী থেকে একটা মেয়ের সংখ্যায় তো কমবে। তবে আর অত ভেবে কি হবে?


এতদিন মহল্লায় বুধিরামের একটা বিরাট নাম ডাক ছিল। পরপর পাঁচটি পুত্র সন্তানের পিতা হওয়ার জন্য। প্রতিবারই বুক ফুলিয়ে সে বউকে নিয়ে ছেলে কোলে হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসেছে। ভগবান কখনো তাকে বিমুখ করেনি। এবারের ঘটনায় বুধির সেই অহং জোর ধাক্কা খেলো।


নিজের ভুল শোধরাতে প্রথম দিনই সে শেষ করে দিতে চেয়েছিল সদ্যোজাত কন্যা সন্তানটিকে। কিন্তু বহু অনুরোধেও রাজি করাতে পারেনি সে কোন ডাক্তার কে। হাতুড়ে ডাক্তার ভ্রুণ হত্যা করলেও শিশু হত্যার ঝুঁকি নিতে রাজি হয়নি। রানী ও অনুমান করতে পেরেছিল স্বামীর মনের কথা। অনেক অনুনয় বিনয় করে সেদিন সে স্বামীর হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছিল সীতার প্রাণ। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও বউয়ের ইচ্ছা মেনে নিয়েছিল বুধিরাম ।কিন্তু জন্মের পর থেকেই সীতা হয়ে উঠলো বাপের চোখের বিষ।

সেদিনের পরই রানী পড়ে ফেলতে পেরেছিল তার আগামী দুঃখের দিনগুলোর কথা। তাই আর সে পুনরায় মা হবার ঝুঁকি নিতে চায়নি। একেবারে বন্ধ্যাত্ব করন করেই বাড়ি ফিরেছিল সে। এ ব্যাপারে বুধিরামের সম্মতি আদায়ে কম কাঠ খড় তাকে পোড়াতে হয়নি। হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর সহযোগিতা না পেলে একা রানীর পক্ষে বুধিরাম কে বশ করা সহজ হতো না। এর সঙ্গে সরকার থেকে এ জন্য পাওয়া টাকা কটাও স্বামীর মন গলাতে বড় সহায় হয়ে ছিল। সে যাই হোক বুধিরাম তখনকার মতন স্ত্রীর সমস্ত আবদার মেনে নিলেও এ সবকিছুর পিছনে যে তার কন্যা সন্তানটি দায়ী, এ ধারণা চিরদিনের জন্য মনে গেঁথে রইল। বছর বছর বউ কে যে গর্ভবতী না করতে পারে সে আবার পুরুষ নাকি! একটাই পথ এইগুলি বস্তির প্রাচীন ইতিহাস তো তাই বলছে।


জন্মের পর থেকে নিজের মেয়েকে কোনদিন ছুঁয়েও দেখেনি বুধিরাম। বাপের আদর কাকে বলে তা অজানাই থাকলো সীতার জন্য। যতদিন সে ছোট কোলের শিশুটি ছিল তাও একরকম, যদিও গঞ্জনা থেকে পুরোপুরি রেহাই কোন কালেও সে পায়নি। রান্নায় সামান্য দেরী বা স্বাদ খারাপ হলেই দোষ পড়ত মেয়ের উপর। মা নাকি মেয়ের অতিরিক্ত যত্নআত্তি করার জন্য রান্নায় মনোযোগ দেয়নি। রাতে শিশুটি কেঁদে উঠলেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতো বাপ। সারাদিনের পরিশ্রমের পর রাতের ঘুম মাটি হয়ে গেল মেয়ের জন্য। এরকমই নিত্য গঞ্জনা শুনতে শুনতে বড় হতে থাকলো অবোধ শিশুটি।


বয়স বাড়ার সাথে বাড়তে থাকলো মেয়েটির প্রতি দুর্ব্যবহার। বাপের সাথে যোগ দিলো বড় ভাই গুলিও। এরকম একটা দিনের ঘটনার পর রানী ভরসা করে মেয়েকে কাছে রাখার সাহসটুকু হারিয়ে ফেলল। বেচারা ছোট্ট মেয়েটা বাপ দাদাদের ভয়ে সর্বদা থাকে ঘরে। শখ আহ্লাদ বলে কোন বস্তু নেই। বুকের দুধ ছাড়ার পর থেকেই সমস্যাটা শুরু। গলা ভাত আর ফ্যান ছাড়া কিছুই পায় না। যেটুকু দুধ বাড়িতে আসে তা কেবল ছেলেদের জন্যই বরাদ্দ। দুধ বড় ভালোবাসে সীতা। যদিও খাওয়ার সৌভাগ্য কোনদিন কপালে জোটেনি। মেয়ে মানুষের আবার দুধের কি প্রয়োজন! কিন্তু দুধের গন্ধটা বড় প্রিয় ওর। মা যখন উনুনে দুধ জ্বাল দেয়, প্রতিবার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় ও। নাকটা কাছে নিয়ে গিয়ে লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে গন্ধটা শোকে। খাওয়ার ভাগ্য না হোক, ঘ্রাণ নেওয়ার শাস্তিও যে এত কঠোর হতে পারে তা অনুমান ছিল না।


সীতার দুধের গন্ধ শোকার খবরটা অজ্ঞাত ছিল না কারো। সেদিন দুধ খাওয়ার পর বড় ছেলেটার শুরু হলো প্রবল বমি। সে যেন আর থামতেই চায় না। মিনিটে মিনিটে বমির ফোয়ারা ছুটছে। সবে কিছুদিন হল ছেলেটা খনির কাজে লেগেছে। এহেন রোজগেরে ছেলের শরীর খারাপের দায়ভার এসে বর্ষালো বেচারা সীতার উপর। গলা পর্যন্ত দেশী মদ খেয়ে ছেলের যে আগেই অম্বল হয়েছিল, তার উপর দুধ পড়তেই যে এ অবস্থা, তা আর কে বুঝবে! অগত্যা শুরু হলো প্রহার। সীতা র কুনজরেই নাকি দুধে বিষ মিশে গেছে। কিন্তু বাকি ভাই গুলি কেন সুস্থ আছে সেটুকু বোঝার মতন বোধ বুদ্ধি বাপ দাদাদের কোন কালেই ছিল না। হাতের কাছেই যখন অজুহাত খাড়া আছে তখন আর বৃথা সময় নষ্ট কেন!


বোধ হয় মরেই যেতো। রানী সেদিন কোন রকমে ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা করেছিল মেয়ের প্রাণ। সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা হয়েছিল ওর বাপের নিদান। আজকের পর যেন আর ঘরে না থাকে সীতা।


সেদিন সন্ধ্যের পর বাপ দাদারা বাড়ি ফিরে আর দেখতে পায়নি কেউ সীতাকে। অবশ্য তার জন্য কেউ খোঁজ ও করেনি। স্বামী পুত্রেরা সকলে যে যার কাজে চলে যাবার পর মেয়ের হাত ধরে রানী এসে দাঁড়ালো বাস রাস্তার ধারে। খনি ম্যানেজার ঘোষবাবুর ঘরে ঠিকে কাজ করতো রানী। কিছুদিন থেকেই মেয়েকে বাঁচানোর জন্য একটা নিরাপদ আস্তানার খোঁজে ছিল সে। ম্যানেজার বাবুর সন্তানহীন শ্যালক ও তার স্ত্রী সীতাকে দত্তক নেবার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল জামাইবাবুর মারফত। কিন্তু বুক খালি করে অন্যের হাতে চিরদিনের জন্য মেয়েকে তুলে দিতে কিছুতেই রানীর মন সায় দিচ্ছিল না। সেদিনের ঘটনার পর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রানী তার সমস্ত ইচ্ছে অনিচ্ছাগুলো পাথর চাপা দিয়ে মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। যেমন করেই হোক ওকে বাঁচাতেই হবে।


আসানসোলে বেশ সচ্ছল অবস্থা সরকার পরিবারের। স্বামী স্ত্রী মোটে দুটি প্রাণী। কর্তা সোহমজিত সরকার মোটর পার্টস এর ব্যবসায়ী। জিটি রোডের উপর বড় দোকান। অভাব বলতে কেবল একটি সন্তানের। বহু চিকিৎসা করেও কোন লাভ হয়নি। ইদানিং স্বামী-স্ত্রীতে কোন শিশু দত্তক নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। সীতার কথাটা শোনার পর জামাইবাবু মারফত প্রস্তাবটা রানীকে দিয়েছিলেন ওনারা। কিন্তু তখনকার মতন রাজি করানো যায়নি রানী কে। মনের মধ্যে টানাপোড়েন এ "ভেবে দেখি বাবু" বলে এড়িয়ে গিয়েছিল রানী। আজ সেইই কিনা মেয়ের হাত ধরে এসে দরজার বেল বাজালো সরকার বাবুদের বাড়ির।


ফোনে খবর টা পাওয়া মাত্র দোকান ছেড়ে বাড়িতে উপস্থিত সোহম। খুশিতে ঝলমল তার স্ত্রী। কেবল অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে রানী। দশ মাস নিজের গর্ভে ধরে শরীরের রক্ত মাংস দিয়ে যাকে জন্ম দিয়েছে, কোন মা কি পারে সেই সন্তানকে ত্যাগ করতে! কিন্তু সন্তানের ভালো মা ছাড়া আর কে বুঝবে! বুকের মাঝে হাজার ঝড়ের ধাক্কা সামলে সে সীতাকে তুলে দিল সরকার বাবুর হাতে।


বেচারা মেয়েটা জন্মাবধি অত্যাচারিত হয়ে প্রতিবাদের ভাষাটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে। শেষবারের মতো মায়ের আচলটুকু টেনে ধরে মৃদু আপত্তি বোধ হয় প্রকাশ করেছিল সে। সরকার গিন্নির স্নেহ ভরা হাত তাকে বুকে টেনে নিতেই বিহ্বলতায় ছেড়ে দিল মায়ের আঁচল। জন্ম অবধি এমন পরশ তো পায়নি কখনো।


বিকেলের মধ্যেই রানী ফিরে এসেছিল নিজের বস্তিতে। সরকার বাবুদের কাছে সীতার যে কোন অবহেলা হবে না, সে বিশ্বাস দৃঢ হয়েছে ওদের দুজনকে দেখে। তবুও পুরোপুরি মেয়ের সত্ব অধিকার সে দিয়ে আসেনি। যখন ইচ্ছা তখন মেয়েকে দেখতে আসতে পাবে, কথা নিয়েছে উনাদের কাছ থেকে। বিচক্ষণ সরকার দম্পতি জানত কোল থেকে শিশু তুলে আনা যায় কিন্তু মায়ের মন থেকে সন্তানকে আলাদা করা যায় না। তাই রানীর ইচ্ছাকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে কোলে তুলে নিয়েছিল সীতাকে।


ক্রমশ কালের আবর্তে সরকার পরিবারে প্রতিপালিত হতে থাকলো রানী।




সকালে কাগজটা খুলতেই মেজাজটা বিগড়ে গেল ডিএম সাহেবার। গোটা জেলা জুড়ে এসব হচ্ছেটা কি! রাজ্যের সবচাইতে বর্ধিষ্ণু জেলা বর্ধমান আর দুর্গাপুর-আসানসোল সবচাইতে বড় শিল্প তালুক ও বটে। ছোটখাটো খুন ডাকাতি, খনি অঞ্চলে মাফিয়াদের দাপাদাপি সবই খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তা বলে এত বড় পুকুর চুরি! শুধু চুরি তো নয়। সাধারণ মানুষের জীবন নিয়েও ছিনিমিনি খেলা। পরিতক্ত খনি গহ্বরে অবৈধ কয়লা উত্তোলনের সময় মাটি ধ্বসে মজুরের মৃত্যু। আহত ২৫ জন। খবরটা পড়া ইস্তক মাথাটা গরম হয়ে গেল ম্যাডাম এর। স্থানীয় পুলিশ, ইসিএল কর্তৃপক্ষ, সব করছে টা কি! রাত দিন শুধু বসে বসে ঘুষ নেওয়া! ফোন করে পত্র পাঠ ডেকে পাঠালেন বিডিওকে।


উপরওয়ালার ডাক পেয়ে সকাল সকাল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন বিডিও সাহেব ডিএম এর বাংলোতে। খবরটা তার কানেও এসেছে। এবং তার পর থেকেই মনের মধ্যে নানা গল্প ও অজুহাত তৈরি করে রেখেছেন। বেশ ভালো করেই জানতেন যে কোন মুহূর্তে ম্যাডামের ফোন আসবে এবং ঘটনার কৈফিয়ত তাকে দিতেও হবে । সৎ, পরিশ্রমী ও কাজ জানা এই ডিএম জেলায় বদলি হয়ে আসা থেকেই বিপদ ঘন্টা বাঁচতে শুরু করেছে সকলের জন্য। ভয়ে তটস্থ হয়ে রয়েছে জেলার প্রতিটি নিম্ন আধিকারিক। সৎ মানুষকে ভয় বোধহয় প্রত্যেকেই পায়।


প্রশ্নটা করতেই গর গর করে বিডিও সাহেব মুখস্ত বুলি আউরে দিলেন ম্যাডামের কাছে।


-আপনি ম্যাডাম এ সব নিয়ে চিন্তা করবেন না। গতকাল সন্ধ্যের পর একটা পরিতক্ত খনিতে কয়েকজন ইল্লিগাল ডিগিং করে কয়লা তুলছিল। তাতে উপর থেকে মাটি ধ্বসে কয়েকজন মারা গেছে। বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। আমি রানীগঞ্জ থানার ওসিকে ফোর্স নিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। লোকাল ফায়ার ব্রিগেড ও আসানসোল ফায়ার সার্ভিস থেকে লোক এসে সবাইকে রেসকিউ করে নিয়েছে। কয়েকজন লোকাল হাসপাতালে এডমিট হয়েছে। কম ইনজিওরড কয়েকজনকে ফাস্ট এড দেওয়া হয়েছে ও অ্যারেস্ট করা হয়েছে আন অথরাইজড কোল লিফটিং এর চার্জে। ওসিকে অর্ডার দিয়েছি অ্যাডমিট হওয়া লোক গুলো হসপিটাল থেকে রিলিজ হলেই এরেস্ট করতে আর ডেড বডি গুলো আসানসোল পাঠিয়েছি পোস্টমর্টেমের জন্য। বর্তমানে লোকাল পুলিশ ওখানে চার্জে আছে। এইমাত্র ওসি র সাথে কথা হয়েছে। এভরিথিং ইজ পিসফুল। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন বিডিও সাহেব।


-হ্যাঁ পিসফুল তো হবেই। এতগুলো লোকের প্রাণ চলে গেল পিসফুল হবে না! আপনাদের কোন দায়িত্ববোধ আছে?


-ম্যাডাম কতগুলো লোকাল হুলিগান এর জন্য আপনি উত্তেজিত হবেন না।আপনার চিন্তা নেই। আমি ব্যাপারটা ক্লোজলি ইন্সপেক্ট করছি।


-তাই করুন আর শুনুন সাত দিনের মধ্যে আমার পুরো ম্যাটারটার ডিটেলস চাই। মনে রাখবেন সাত দিন মানে সাত দিনই।


ডিএম বাংলো থেকে বেরিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচল বিডিও সাহেব।


ঘটনার পর বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। বিডিও এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ডিএমকে ঘটনার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানিয়েছেন। তিনি মোটামুটি কনভিন্স করেই ফেলেছিলেন যে কিছু কয়লা চোর ওই দিনের ঘটনার জন্য দায়ী, এর বেশি কিছু নয়। তবে ম্যাডামের নির্দেশে ওই ইললিগাল মাইন্স গুলো ফিলিং করে ফেলতে হবে। সবই সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ততদিনে আবার নতুন কোন ঘটনা ঘটে যাবে। ম্যাডাম নিশ্চয়ই এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। ফিলিং করে ফেলুন বললেই তো আর হলো না! ওখান থেকে যা রোজগার আসে তা বন্ধ হলে অনেকের সংসারের হাড়ির হাল হবে। কত কেষ্টবিষ্টু যে ওই অবৈধ খনি গুলোর উপর নির্ভরশীল তা ম্যাডাম কি আর জানে! আর জানতে পারলে ম্যাডাম কি আর এগোতে সাহস পাবেন! তার পরেও যদি এগোন তবে তো সোনায় সোহাগা! ম্যাডামকে আর বেশিদিন থাকতে হবে না এ জেলায়। পরের পোস্টিং নির্ঘাত মাওবাদী অঞ্চলে হবে।


সবই ঠিকঠাক চলছিল। ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘুরলো একদিন সকালে এক গরীব মহিলার উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে। নতুন ডিএম জেলার দায়িত্ব নেওয়ার পরই একটা নিয়ম চালু করেছিলেন। প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে নটা নিয়ম করে জেলার সাধারণ মানুষের মুখোমুখি হন উনি। ওই সময় জেলার যে কোন ব্যক্তি তার অভাব অভিযোগ নিজ মুখে সরাসরি ম্যাডামকে জানাতে পারেন। তারপর ম্যাডামের নির্দেশ মতো সেই অভিযোগ সঙ্গে সঙ্গে পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে, এবং সাত দিনের মধ্যে সেই অভিযোগের সমাধান করতে হয়, অথবা সমাধান না করতে পারার কারণ দশাতে হয়।


বর্তমান ডিএম এর এই নিয়ম ইতিমধ্যেই খুব সাফল্য লাভ করেছে। এলাকার বাসিন্দা ছাড়াও দূর দূর থেকে বহু মানুষ সকালবেলা এসে হাজির হয় বাংলোর সামনে। সকলেই শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে অপেক্ষা করেন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সেদিনও এরকমই নানা অভিযোগ অফিসারেরা ম্যাডামের নির্দেশে ফাইল বন্দি করে তাতে অভিযোগকারীর স্বাক্ষর করিয়ে নিচ্ছিলেন। সভাস্থলে পিছন দিকে এক বয়স্ক মহিলা লম্বা ঘোমটায় মুখ ঢেকে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছেন। তাকে দেখে কোন তাড়া আছে বলে মনে হয় না। জায়গাটা বেশ কিছুটা ফাঁকা হওয়ার পর সেই মহিলা ধীরে ধীরে সামনে এসে জোড়হাতে 'বিটিয়া' বলে সম্বোধন করতেই একজন আধিকারিক তার নাম ঠিকানা জিজ্ঞাসা করেন।


-হুজুর আমি গরীব মানুষ, বস্তিতে থাকি, নাম ঠিকানা না হয় নাই বললাম।


-দেখুন এখানে অভিযোগ জানাতে গেলে নাম ও ঠিকানা লিপিবদ্ধ করাটা জরুরী।


-আমার নাম ঠিকানা বলার অসুবিধা আছে, হুজুর যদি এতে আমার কথা শোনেন তাহলে বলব না হলে আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। উপস্থিত অফিসারেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ম্যাডামের নির্দেশের অপেক্ষায় তারা অধীর। অবশেষে আসরে নামলেন ম্যাডাম।


-আপনি আমার ঘরে গিয়ে বসুন। আমি আলাদা করে আপনার সঙ্গে কথা বলব।


-হুজুর আমার কোন অভিযোগ নেই, আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি।


-চলে যাচ্ছি বললেই আপনাকে আমি যেতে দিতে পারি না। আপনার প্রয়োজন না থাকলেও অভিযোগটা আমায় জানতেই হবে। আপনি নিশ্চিন্তে আমার ঘরে গিয়ে বসুন। এখানে আপনার নিরাপত্তা সম্পূর্ণ সুনিশ্চিত।


-মহিলা অগত্যা ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে বাংলোর ভিতর অফিস ঘরে গিয়ে বসেন।


-বাকি সভা কোনমতে শেষ করে ম্যাডাম অফিসে গিয়ে মুখোমুখি হন মহিলাটির। গলার আওয়াজ যেন বড় চেনা চেনা ঠেকছে অথচ কিছুতেই মনে করতে পারছেন না। ভদ্রমহিলাকে লম্বা ঘোমটার আড়ালে মুখটাও অদৃশ্য সবকিছু মিলে কৌতূহলের বশে আজ তাড়াতাড়ি সভা শেষ করে উঠে এসেছেন। ব্যাপারটি তার পুরো স্বভাব বিরুদ্ধ, তাই অধস্তন কর্মচারীরা বেশ তটস্থ। কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটনা এর পিছনে আছে বুঝে সবাই ম্যাডামের থেকে দূরে রয়েছেন।


অফিসে ঢুকেই সমস্ত দরজা জানালা গুলো বন্ধ করে দিলেন ম্যাডাম নিজে হাতে। ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন বৃদ্ধার সামনে।

-এতদিনে আমার কথা মনে পড়ল মা।

চমকে উঠলেন বৃদ্ধা।

-কে তোমার মা বিটিয়া?

-দুনিয়ার সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না তুমি! তোমার বিটিয়া ডাক শুনে আমি চিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে পড়ে ছোটবেলায় তুমি কেবল আমাকে বিটিয়া বলে ডাকতে। তুমি ছাড়া আর কেউ তো সংসারে আমাকে মেয়ের মত স্নেহ করেনি।

কোন উত্তর নেই উল্টো দিক থেকে। কেবল বড় বড় দু ফোটা চোখের জল বৃদ্ধার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নিচে মেঝের উপর।

-নতুন মা বড় বাবার কাছে আমাকে রেখে যাবার পর তুমি তো নিয়ম করে প্রতিমাসে আসতে আমাকে দেখতে! তারপর হঠাৎ করে বন্ধ করে দিলে আসা। আমি প্রতিদিন ছটফট করতাম তোমাকে দেখার জন্য, ঘন্টায় ঘন্টায় জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াতাম। ভাবতাম আজ বুঝি তুমি নিশ্চয়ই আসবে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দৌড়ে গিয়ে নতুন মাকে জিজ্ঞাসা করতাম তুমি এসেছিলে কিনা। কিন্তু তুমি আর এলেনা। ভেবেছিলাম পরিবারের আর সবার মত তুমিও ভুলে গেছো আমাকে।

কথার মাঝে নিজের পদমর্যাদা ভুলে কিছুটা অভিমানী হয়ে পড়েছিলেন ম্যাডাম। নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করেন

-তা এতদিন বাদে কি প্রয়োজনে আমার কাছে?

চমকে উঠে এবার মাথার ঘোমটা সরিয়ে ফেললেন বৃদ্ধা। সোজা মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন

-তুই কি আমার খোঁজ নেবার চেষ্টা করেছিস এতদিনেও?

-জানতাম এ প্রশ্নটা তুমি করবে। চাকরিতে জয়েন করে প্রথম দিনই আমি একজন অফিসার কে পাঠিয়েছিলাম ওই কুলি লাইনে, শুধু তোমার খোঁজ নিতে। ফিরে এসে সে জানায় ওই নামে ওখানে কেউ থাকেনা। এরপর আমি কিভাবে খোঁজ নিতে পারতাম তোমার? যে ইচ্ছে করে হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে পাওয়া কি এতই সহজ?

রানীর মনে পড়ে বেশ কিছুদিন আগে একজন ভদ্রলোক এসে বুধিয়ার খোঁজ করেছিল বটে। তবে ভয় কেউ খোঁজ দেয়নি। অজানা অচেনা লোক খোঁজখবর নিলেই বস্তির সবাই ভয়ে মরে, কে জানে পুলিশ না মাফিয়াদের লোক সে। তাই সহজে কেউ পরিচয় জানাতে চায় না। ভদ্রলোকদের তো নয়ই।

-হ্যাঁ একজন এসেছিল একদিন কিন্তু ভয়ে আমরা কেউ পরিচয় দিইনি। সে যে তোর ই পাঠানো লোক তা বললেই পারতো।

-বেআইনি কাজ করলে ভয়তো পাবেই। তাছাড়া আমার নির্দেশে সে পরিচয় গোপন রেখেছিল।

-বেআইনি বলছিস কেন?

-তোমার স্বামী ছেলেরা বন্ধ খনি থেকে লুকিয়ে কয়লা তোলে না? মাল গাড়ি থেকে কয়লা চুরি করে না? সেগুলো বেআইনি নয়?

-ভুলে যাস না ওরা তোর বাপ দাদা

-না ওরা আমার কেউ নয়। ওরা কি স্বীকার করেছিল আমাকে ওদের মেয়ে বা বোন বলে

-তাহলে লোক পাঠিয়েছিলি কেন খোঁজ নিতে? মজা দেখতে, নাকি আমরা এখনো বেঁচে আছি কিনা দেখতে?

-আমি তোমার খোঁজ নিতে লোক পাঠিয়েছিলাম বাকি কারো জন্য নয়।

-বাকি লোকগুলোকে যদি অস্বীকার করিস তবে আমাকেই বা স্বীকার করছিস কেন?

-তুমি আমার মা বলে! যদিও তুমি নতুন মার কাছে আমাকে রেখে গিয়ে নিজের দায়িত্ব শেষ করেছিলে, তবুও সেদিন তুমি আমার প্রাণ না বাঁচালে আজ আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম না! সেটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ আমার আছে! তোমাদের মতন দায়িত্ব থেকে পালাতে শিখিনি।


কথার মাঝে দরজায় জোরেজোরে আওয়াজ।

-দরজা খোল। কার সাথে কথা বলছিস তুই বন্ধ ঘরে। দরজা খোল বলছি

ছিটকিনি খুলতেই হুড়মুড় করে ঘরে প্রবেশ করলেন সীতার নতুন মা

­­­­­-কি হয়েছে তোর দরজা বন্ধ করেছিলি কেন?

-ভালো করে দেখো তো তুমি এনাকে চেনো মা?

মা কথাটা কানে বাজলো মিসেস সরকারের। এতকাল সীতা নতুন মা বলেই ওকে সম্বোধন করে এসেছে, আজ হঠাৎ মা কথাটা জোর দিয়ে উচ্চারণের কারণ বুঝতে পারলেন না

-ওমা রানী কতক্ষণ এসেছো তুমি? আর ওকে চিনবো না কেন? ও তো তোর মা!

"মা!" তাচ্ছিল্যের স্বরে উচ্চারণ করলো সীতা -মা হওয়ার মতন কোন কাজটা উনি করেছেন যে উনাকে মনে ধরে রাখতে হবে?

-সীতা! ধমকে উঠলেন মিসেস সরকার। -কার সাথে কিভাবে কথা বলছিস তুই?

-পেটে ধরলেই যদি মা হওয়া যায় তবে ওইটুকু কাজ তুমি করেছিলে বটে! তারপর সব দায়িত্ব শেষ! মেয়ে বাঁচল কি মরল সে খবরটুকু নেবার প্রয়োজন এতকাল উনার হয়নি, আর আমাকে স্বীকার করতে হবে নাকি মা বলে! আমার মা বলে কেউ যদি থাকে সে কেবল তুমি!

-কি বলছিস? সীতা, তুই আজ এখানে দাঁড়িয়ে কার জন্য জানিস?

-বৌদি তুমি কথা দিয়েছিলে আমাকে

-এতদিন আমি তোমার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছি। তা বলে তুমিও দাড়িয়ে দাড়িয়ে অপমানিত হবে আর আমি শুনবো? আমাকে বলতে দাও। শোন, আমার কাছে তোকে দিয়ে গিয়ে তোর প্রাণ বাঁচিয়ে শুধু উনি ওনার কর্তব্য শেষ করেননি, তুই যে আজ ডিএম হয়েছিস, সেটা ওনার জন্য। এত দারিদ্রের মধ্যেও প্রতিমাসে নিয়ম করে উনি তোর পড়াশোনা খরচ জুগিয়ে গেছেন। সেই পয়সাগুলো কিন্তু তোর বাপের বা বড়বাবার দেওয়া পয়সা নয়। লোকের বাড়ি কাজ করে টাকা আয় করে তোর জন্য খরচ করেছে এই মহিলা। স্কুলে পাড়ায় তারপর কলেজে তোর পরিচয় পাছে জানাজানি হয়, তাই সামনাসামনি তোকে দেখতে আসাও বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রতি সপ্তাহে ফোন করে তোর খোঁজ নিতে কখনো ভোলেন নি। তুই স্কুলে চলে গেলে মাঝে মাঝেই এসে তোর জামা কাপড় বই খাতা সব গুছিয়ে রেখে যেত। মাথার দিব্যি রেখে আমার মুখ বন্ধ করে রেখেছিল ও। এতদিন বাধ্য হয়ে আমি তোকে মিথ্যা বলতাম। তাকেই কি না তুই আজ মা বলতে অস্বীকার করছিস? ওরে হতভাগী, আমরা কেবল তোকে আশ্রয়টুকু দিয়েছি আর যা করার সব করেছে রানী। ওর মতন মা কজন হতে পারে এই সংসারে?


অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে সীতা রানীর দিকে। দুচোখের জলের ধারায় ভিজে উঠেছে গোলাপি গাল। ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরে রানীর দুটি পা।

-আমায় ক্ষমা করো মা। এতসব কথা আমি জানতাম না। আর আমি ভুল করেছিলাম তোমায় চিনতে।

নিচু হয়ে মেয়েকে তুলে জড়িয়ে ধরে রানী নিজের বুকে। মা মেয়ের আনন্দ অশ্রু ধারা মিলিত হয়ে ঘরে বয়ে আনে খুশির জোয়ার।

-এতে তোর কোন দোষ নেই রে মা, সবই আমার অদৃষ্ট। না হলে তোর মত মেয়েকে ছেড়ে কেউ থাকতে পারে? তুই যে আমার গর্ব। তবুও বলি এই তোর নতুন মা আর বড় বাবা, এরা যদি তোকে আশ্রয় না দিত, তবে এতদিনে তুই কোথায় হারিয়ে যেতিস! এদের দুজনের অবদান কখনো ভুলে যাস না।

বহুদিন পর মা মেয়ের সাক্ষাতে কথা কথা যেন আর ফুরাতেই চায় না। এতদিনের বিরহের পর কেউ যেন কাউকে ছাড়তে চাইছে না। মিসেস সরকার রসিকতা করে বলে ওঠেন

-সীতা, আসল মা কে পেয়ে তো আর এই নকল মায়ের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছিস না

মিসেস সরকার এর কথায় স্বাভাবিক হয় এবার দুজনে।

রানী নতুন মায়ের দিকে ফিরে বলে

-কে বলে তুমি আমার নকল মা! তুমি আমার মা জগদ্ধাত্রী। চলো ভিতরে যাই। আজ আর কোন অফিস নেই। আজ আমার ছুটি। সারাদিন আজ আমরা তিন মা মেয়েতে মিলে চুটিয়ে গল্প করবো।


কথা বলতে বলতে তিনজনের ভেতরের ঘরে প্রবেশ করে।

-কিরে সীতা তোর বড় বাবাকে দেখছি না?

-দেখবে কি করে? সে তো এখানে থাকেনা

-থাকেনা কেন?

-বড় বাবা ব্যবসা ছেড়ে আসানসোল থেকে নড়বে না, আর নতুন মা আমাকে ছেড়ে থাকবে না! তাই আমরা দুজন এখানে, মানে বর্ধমানে, আর বড় বাবা আসানসোল। তবে প্রতি শনি রবিবার আমরা আসানসোলে গিয়ে থাকি।

-তুমি আমার মেয়ের জন্য নিজের স্বামীকে ছেড়ে এখানে থাকো?

-সেকি, তোমার মেয়ে, ও কি আমারও মেয়ে নয় নাকি?

-বৌদি জগতে ভগবান বলে যদি কিছু থাকে তবে আমার কাছে সেটা তুমি। তোমার এই ত্যাগ আমি মৃত্যু পর্যন্ত ভুলবো না। এই মেয়ে তো তোমারই।

-এই জ্যাঠামি করতে হবে না। আর চল রান্নায় হাত লাগাই। এই বুড়ো বয়সে আবার স্বামীকে কি দরকার গো? দুদিন বাদে মেয়ের বিয়ে দেবো। তারপর তো আবার স্বামীর ঘর সামলাতেই হবে। তার আগে কটা দিন মেয়ের সাথেও ঘর করে নি।

কথায় কথায় বেলা বাড়তে থাকে। দুপুরে খেতে বসে একটা পারে।

-তুমি কি একটা অভিযোগ নিয়ে এসেছিলে সেটা তো শোনা হলো না।

-থাক ও আর তোর শুনে কাজ নেই।

-কেন এ কথা বলছ কেন? কি এমন সমস্যা তোমার যা আমি সমাধান করতে পারব না? তুমি জানো তোমার মেয়ের কত ক্ষমতা এখন?

-ক্ষমতা তোর আছে মা তা আমি জানি, আর তাই এতদিন পর ছুটে এসেছিলাম তোর কাছে একটু সাহায্যের আশায়, কিন্তু..

-থামলে কেন মা? তোমার কি সাহায্য প্রয়োজন বল! টাকা পয়সা কোন ব্যাপার

-না রে পাগলি তোর কাছে আসতাম না টাকা পয়সার কোন ব্যাপার হলে। আসলে সমস্যাটা তোর বাবাকে নিয়ে।

-কেন কি করেছে আবার লোকটা তোমার সাথে?

-লোকটা নয় রে। ভুলে যাস না সে আমার স্বামী।

-তোমার কাছে যাই হোক, আমার কাছে লোকটা বই আর কিছু নয়

-সেজন্যই তো বললাম তোর আর শুনে কাজ নেই

-বেশ তা বলো কি হয়েছে ওনার?

-তুই তো জানিস কিছুদিন আগে আমাদের ওখানে একটা খনিতে মাটি ধ্বসে কিছু শ্রমিক মারা যায় আর কিছু আহত হয়?

-হ্যাঁ, সে তো অবৈধ খনি থেকে কয়লা চুরির ব্যাপার।

-আগে পুরোটা শোন তারপর না হয় বৈধ অবৈধ মন্তব্য করবি!

-তারপর লোকটাও ছিল নাকি সেখানে?

-সেও ছিল, তবে প্রাণে মরেনি। পঙ্গু হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে

-তা আমি কি করবো?

-ওনার প্রিয় ছেলেদের গিয়ে বল তাদের বাবাকে সাহায্য করতে।

-ছেলে গুলো একটাও মানুষ নাকি! একটা তো রেল পুলিশের গুলিতে গেল ওয়াগান থেকে কয়লা তোলার সময়। একটা তো মরল বিষ মদে। বাকি তিনটের মধ্যে একজন তো কবে আলাদা হয়েছেন বউ নিয়ে। আরেকটি রাত দিন মদ খেয়ে পড়ে থাকে, কোন কাজকর্মে মন নাই। বাকি রইলো একটি - কবে বাড়ি ফিরবে আর কবে ফিরবে না সেই জানে! চুরি ছিনতাই এসব নাকি করে বেড়ায়। তা কার উপর নির্ভর করবো বল?

-কেন তোমার স্বামী তো পাঁচটি পুত্ররত্ন জন্ম দিয়েছিল বলে গর্বে মাটিতে পা পড়তো না। তিনি এখন কি বলছেন?-

তুই কি বাকি কথাগুলো শুনবি নাকি বাপ বাপান্ত করবি?

-শুনে কি করব? উনি আজ হাসপাতালে, কিন্তু একটু সুস্থ হলেই তো পুলিশ হাজতে নিয়ে ভরবে

-আমার প্রশ্ন সেটাই। ওনাদের হাজতে কেন পুরবে?

-মানে! চুরি করে কয়লা তুলবে, বেআইনি কাজ করবে, আর হাজতে পুরবে না?

-চুরি করে কয়লা ওনারা কি করে তোলে সেটা খোঁজ নিবি না? ওই খনিগুলো তো বন্ধ করে দেওয়ার নিয়ম! সেগুলো বন্ধ হয়নি কাদের জন্য? তারা হাজতে ঢুকবে না? হুকুম সিং, যার আড়তে ওই চুরির কয়লা বিক্রি হয় তার সাজা হবে না? পুলিশ, যাদের দায়িত্ব খনির পাহারা দেওয়া, কিন্তু ঘুষ খেয়ে পিছন ফিরে থাকে - তারা কেন ছাড় পাবে? দোষ কি কেবল ওই গরিব লোকগুলোর, যারা দুটো পয়সার জন্য জীবনের বিনিমযে খনি থেকে কয়লা তুলে আনে, আজ যাদের জীবন গেল, তাদের পরিবারের কি হবে বলতে পারিস?


দম বন্ধ করে বসে কিছুক্ষণ ভাবে সীতা। সত্যিই তো এই কথাগুলো তার মাথায় কেন আসেনি? বুধিরাম যদি অপরাধী হয় তবে বাকি এইসব লোকগুলিও সমান অপরাধী। ওরা কেন পার পেয়ে যাবে?

-ঠিক আছে, আমায় তুমি আজকের দিনটা একটু ভাবতে দাও। দেখি কাল কি করতে পারি

-তাহলে আমি আজ যাই।

-সেকি চলে যাবে?

-হ্যাঁ, আমাকে একটু আমার বাড়ি ফিরতেই হবে।

-সেখানে তো কেউ নেই, তবে তুমি কেন যাবে?

-বিয়ে কর, সংসার কর, তারপর তোকেও একদিন আমি এই প্রশ্নটা করবো। দেখব সেদিন তুই জবাব দিস।


বেরিয়ে পরে রানী বাংলো থেকে। বড় ইচ্ছে হচ্ছে তার চিৎকার করে সবাইকে শোনাতে দেখে যাও তোমরা, ওই বিশাল বাংলোতে যে থাকে, সে আমার মেয়ে। এই গরিব দুঃখী মানুষের রক্ত বইছে ওর শরীরে। আজ আমি এই পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মা। বিশ্বাস করবে কি কেউ? মনে হয় করবে না, পাগলী ভাববে। বলা যায় না, পাথর ছুড়েও মারতে পারে কেউ। থাক বরং চুপ করেই থাকি। এতকাল তো চুপ করেই কাটলো, তবে আজ আর মুখ খুলে কি হবে? মেয়ের উপর প্রত্যাশা কি খুব বেড়ে যাচ্ছে? সামনেই আসানসোলের দিকে যাবার বাস এসে থামতে উঠে পড়ে তাতে। সীতা চেয়েছিল মাকে গাড়ি করে পৌঁছে দিতে, রাজি হয়নি রানী। তার তো কোন চাহিদা নেই মেয়ের কাছে। সে কেবল চেয়েছে হতভাগ্য ওই মানুষগুলি যেন সুবিচার পায়। মেয়ের কাছে নয়, সাহায্য চেয়েছে সে সরকারের কাছে।


পরদিন সকালে হাসপাতালে এলো সীতা। একে একে সমস্ত আহত শ্রমিকের সাথে দেখা করে এসে দাঁড়ালো বুধিরামের বিছানার পাশে।

-কি নাম আপনার?

-হুজুর বুধিরাম

বুধিরাম কে চিনতে একটুও অসুবিধা হয়নি সীতার। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে রানী। লোকটার চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। শরীর আর আগের মত শক্তপোক্ত নয়। দু হাঁটু ও মাথা এক জায়গায় করে বসে আছে সে। বিছানার উপর কপালে ও বুকে ব্যান্ডেজ বাধা চেহারায় আগের সেই তেজী ভাবটাই নেই। বরং সামনে দাঁড়ানো বড় মহিলা সরকারি অফিসার কে দেখে ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছে সে দেখলেই বোঝা যায়। সীতার মনে মনে বেশ হাসি এলো যে লোকটিকে সে ছোটবেলায় যমের মতন ভয় পেতো, সেই লোকটি আজ তার সামনে বসে আছে জবুথবু হয়ে তারই ভয়ে। ভগবানের কি অপার লীলা। ইশারায় সে রাণীকে চুপ থাকতে বলে, প্রশ্ন শুরু করে বুধিরাম কে

-আপনার বাড়ি কোথায়

-কুলি লাইনে হুজুর

-আপনার ছেলে মেয়ে নেই

-আছে এখন তিনটি ছেলে আছে

-আর মেয়ে?

এবারে চুপ করে থাকে বুধিরাম।

-কি হলো? কি জবাব দিন - মেয়ে আছে আপনার?

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ায় সে

- মেয়ে নেই?

আবারও মাথা নাড়ায় বুধিরাম।

-কিন্তু আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে আপনার একটা মেয়ে ছিল?

-বহুদিন আগে সে হারিয়ে গেছে

-হারিয়ে গেছে না তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে?

এবারও কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকে বুধিরাম।

-তা হারিয়ে যখন গেছিল থানায় খবর দিয়েছিলেন?

-আমরা গরীব মানুষ হুজুর মেয়েকে বিয়ে দেবার ক্ষমতা আমাদের ছিল না

-বাহ চমৎকার তাই জন্য একরতি মেয়েটাকে বের করে দিলেন বাড়ি থেকে। তা খোঁজ নেবারও প্রয়োজন মনে হল না। তা আপনার সেই সুপুত্র গুলি কোথায়? কাউকে তো দেখছি না।

-ওরা কেউ আমার খবর নেয় না

-আপনি জানেন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেই পুলিশ আপনাকে হাজতে পুরবে?

হাউ মাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে বুঝিরাম। হাত জোর করে বলে

-হুজুর আপনি আমার মা বাপ এবারের মতন ক্ষমা করে দিন! কথা দিচ্ছি এ কাজ আর কখনো করবো না।

-ছি ছি একি করছেন আপনি? আমি মেয়ে মানুষ আমার কাছে হাত জড়ো করছেন কেন?

এতক্ষণে মুখ খুলে রানী।

-তুমি কার কাছে জোর হাতে ক্ষমা ভিক্ষা চাইছো জানো? মনে আছে তোমার সীতার কথা? একদিন অবহেলায় দূর করে দিয়েছিলে তুমি বাড়ি থেকে? সেই মেয়ে!


ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে বুধিরাম সীতার মুখের দিকে। নিস্পলক চোখ, মুখের সমস্ত রক্ত যেন উধাও হয়ে গেছে। পাথরের মূর্তির মতন অসাড় হয়ে বসে আছে বিছানায়। একটু বিরতি নিয়ে রানী বলে ওঠে

-তুমি ওকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে আর আমি ওকে মানুষ করেছি তিলে তিলে। তোমাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য। দেখো মেয়েরাও পারে কিনা? তোমরা পুরুষেরা আত্মরক্ষার সময় আশ্রয় নাও মেয়েদের আঁচলের তলায়, অসুর বধে এগিয়ে দাও মা দুর্গাকে! আবার সেই মা দুর্গা যখন সীতার বেশে তোমার ঘরে এলো, তাকে দূর করে দিলে বাড়ি থেকে। নির্লজ্জ তুমি নিজেকে বাঁচাতে আজ তারই সামনে হাত জোড় করে বসে আছো


জবাব দেবার কোন ভাষা নেই আজ বুধিরামের। লজ্জায় হতাশায় মুখ লুকায় দু হাটুর মাঝে।


ব্যক্তিগত জামিনে মুক্তি দিয়েছিল পুলিশ। ডি এম এর আদেশে নতুন করে তদন্ত শুরু হয়। খনি দুর্ঘটনায় হুকুম সিং থেকে বেশ কয়েকজন সরকারি আমলা ও পুলিশ দোষী সাব্যস্ত হয় তদন্তে।

কোর্টে আজ তারিখ পড়েছে। রায়দান পর্বে জজসাহেব একে একে সকলের সাজা ঘোষণা করেন। দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় বুধিরামের দুবছরের জেল হল। তবে শ্রমিকেরা সকলেই যে পরিস্থিতির শিকার, আদালত তা স্বীকার করে নেন। রায়দানের পর বাইরে বেরিয়ে আসে রানী ও সীতা।

-মা এবার চলো আমার কাছে। তাই কি হয় রে মা? আমার যে এখনো অনেক কাজ বাকি।

-তুমি যা চেয়েছিলে সবই তো পালন করার চেষ্টা করেছি আমি। আর তোমার কি কাজ?

-মাত্র তো দুটো বছর! জেল থেকে তো ফেরত এলো বলে!

-তোমার দুঃখ হয় না মা! ওই লোকটা দিনের পর দিন কি অত্যাচার টাই না করেছে, প্রতিরাতে মদ খেয়ে কি মারটাই না তোমাকে মেরেছে! ভুলে গেছো তুমি সবকিছু এত তাড়াতাড়ি?

-কি করব বল? সব ক্ষমা করে দিয়েছি!

-এই জন্যই এই পুরুষ মানুষ গুলো মাথায় উঠে বসে, তোমাদের প্রশ্রয়েই সাহস পায় তোমাদের অপমান করতে, আর তুমি বলছো ক্ষমা করে দিয়েছি।

-কেন ক্ষমা তুই করিস নি? তাহলে তুই জামিনদার হয়ে ছিলি কেন? আদালতে ওদের যেন শাস্তি কম হয় তাই পুলিশ রিপোর্ট হালকা করে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলি কেন?

-সে তো তোমার জন্য।

-আমার জন্য? আদালতের রায়ে মুষড়ে পড়া লোকটাকে দেখে তোর চোখের কোন চিক চিক করেনি! সেটাও কি আমার জন্য?

-মা! বলে দুহাতে জড়িয়ে ধরে সীতা রানী কে।

-দেখ মা, আমি মুখ্যু মানুষ। কে যেন বলেছিল ক্ষমা মানুষের পরম ধর্ম। আমরা তো মানুষ! কিন্তু তারও আগে মেয়ে, মানে মেয়েমানুষ! আর ওরা ছেলেমানুষ! বুঝলি কিছু? ছেলে মানুষিটা ওদেরই শোভা পায়। আমাদের নয় রে!

Comments


bottom of page