top of page

মায়ের পেটের বোন

স্বাগতা বড়ুয়া


তখন আমার কতই বা বয়স! খুব বেশি হলে দশ কি এগারো!আমার পরে আমার দুটো ছোট ভাই-বোন।

প্রতিবার জগদ্ধাত্রী পুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই আমার একমাত্র মাসিমনি আমাদের চন্দননগরের ছোট্ট একতলা বাড়িতে এসে উঠতেন। খুব আনন্দ করে কাটতো জগদ্ধাত্রী পুজোর ওই কটা দিন। মাসিমনির এক মেয়ে ও এক ছেলে।

আমরা তিন ভাই বোন, বাবা মা, মাসি ও মেসো ও তাদের দুই ছেলেমেয়ে মিলে সে এক হই-হই রই- রই কান্ড।

আমার মেসো ব্যবসাদার মানুষ। তার আর্থিক অবস্থা বেশ স্বচ্ছল। নিউ জলপাইগুড়িতে ওদের খুব সুন্দর সাজানো গোছানো তিন-তলা বাড়ি।

মাসীমণি প্রতিবারই জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় আসে, ও ফিরে যাবার সময় কাঁদতে কাঁদতে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে যায়,--"আমি প্রতিবছর তোর কাছে আসি। তুই তো আমাদের ওখানে কোনওদিন গেলি না। আজ আমার বিয়ে প্রায় এগারো বছর হল,একবারও তোর ছোট বোনের কথা মনে পড়ে না রে দিদি?"

মা বলে,--"আমার আর হয়ে ওঠে না রে! জানিসতো, তোর জামাইবাবুর আর্থিক অবস্থা সেরকম ভালো নয়! শ্বশুরমশাই নিজের হাতে এই মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু করে গেছেন বলে ছেলেপুলে নিয়ে কোনো রকমে খেয়ে পরে বেঁচে বর্তে আছি। সেই জন্য কোথাও যাওয়ার কথা আর ভাবি না। ঠিক আছে, এবার তোর জামাইবাবুকে বলে দেখব, কষ্ট করে হলেও দুদিনের জন্য যদি নিয়ে যেতে পারে, তাহলে ঘুরে আসবো।"

-"ঠিক আছে দিদি, তুই যদি যাস ভীষণ খুশি হব। অরুণ তো সবসময় বলে, দিদিরা কি একবারও আসতে পারে না আমাদের বাড়িতে?"

মাসীমণিরা চলে যাবার পরে বাবা যখন রাত্রিবেলা ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে দোকান বন্ধ করে ঘরে এল, তখন মা বাবাকে বলল--" এইবার শীত পড়লে দুদিনের জন্য একটু বোনের বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে এসো না!"

বাবা মায়ের কথা শুনে চুপচাপ মাথা নীচু করে বসে রইল।

মা আবার বলল,--"কতবার করে যেতে বলে!নিজের মায়ের পেটের বোন...."

বাবা সেভাবে কথার উত্তর না দিয়ে ছোট্ট করে শুধু বলল,--" হুম দেখছি।"

শীত এলো। মা বাবা আমরা তিন ভাই বোন চেপে বসলাম ট্রেনে। মাসির বাড়ি যাওয়ার সে কি আনন্দ! বাবার সাধ্যমত ওদের সবার জন্য জামাকাপড়ও কিনে এনেছে।

মাসিমনির বাড়িতে পৌঁছানোর সাথে সাথে মাসীমণি ও তার দুই ছেলে মেয়ে মিলে আমাদেরকে খুব আদর আপ্যায়ন করলো। সেই রাতে মা আর মাসিমনির গল্প যেন আর শেষ হয় না।

ওদের ছোটবেলাকার গল্প,স্কুলের গল্প, মা'র স্কুলের পড়া শেষ হতে না হতেই বিয়ে হয়ে যাওয়ার আক্ষেপ সবই চলতে লাগলো দুইবোনের মধ্যে।পরদিন সকালে উঠেও গল্পের ঝুড়ি আবার খুলে বসেছে দুই বোন মিলে।

এদিকে আমরা পাঁচ ভাই বোন সারা ঘর দাপিয়ে খেলে বেড়াচ্ছি। কত বড় বাড়ি; কত ঘর.. একবার লুকালে আর সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। আর এরা আমাদের কত আদর করছে।আমার তো এখান থেকে আর বাড়ি ফেরার ইচ্ছেই করছিল না।

দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে যে তিনটে দিন কেটে গেল, টেরই পেলাম না। অবশেষে আবার সেই কান্নাকাটি... মাসীমণির জোড়া জুড়ি…..

--"আর দুটো দিন থেকে যা দিদি!"

মা বুঝিয়ে বলল,--" তোর জামাইবাবুর এতদিন ছুটি নেওয়া মানে তো ব্যবসার খুবই ক্ষতি। তাই সামনের বছর আবার চেষ্টা করব, শীতের সময় ঘুরে যেতে। এইবারে কাছাকাছি যে টুরিস্ট স্পট গুলো দেখলাম সেগুলোতে খুব আনন্দ পেয়েছি। সামনে বছর আগে থেকে প্ল্যান করে আমরা সবাই মিলে দার্জিলিং ঘুরে আসবো। "

মাসীমণি ও সাগ্রহে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

বাবা অবশ্য বরাবরই চুপচাপ। এত অনুরোধ করা সত্ত্বেও বাবা কিছুতেই আর দুটো দিন বেশি থাকতে রাজি হলো না বলে আমার ভীষণ মন খারাপ হচ্ছিল। বাবাটা যেন কেমন! মেসোর সাথেও সেই ভাবে গুছিয়ে কথা বলল না। সারাক্ষণ নিজের মধ্যেই চুপচাপ বসে আর খবরের কাগজ পড়ে কাটিয়ে দিল।আমাদের বাড়িতে টিভি নেই আর ওদের বাড়িতে কত বড় টিভি কিন্তু বাবা সেই টিভির দিকে একবার ঘুরেও তাকালো না। বাবার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল আমার!

অতঃপর দুটো রিক্সা করে আমরা ধীরে ধীরে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের দিকে এগোতে লাগলাম। মাসিমনির কান্না ভেজা চোখ দেখে ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। মেসো অবশ্য থাকার জন্য সেই ভাবে কিছু বলেননি।

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের কাছাকাছি আসতেই পুলিশ সমস্ত গাড়ি রিকশা সাইকেল সব আটকে দিতে লাগলো। ওই রাস্তা একেবারে বন্ধ। রাস্তার ওইপাশে নাকি খুব গন্ডগোল হচ্ছে।ভোটের আগে দুই রাজনৈতিক দলের সাংঘাতিক মারামারি হয়েছে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে দিচ্ছে।

বাবার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়লো। বাবাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল বাবা যেন খুব অসহায় হয়ে পড়েছে। কোন দিক দিয়ে স্টেশনে যাওয়া যাবে সেই আলোচনা করতে লাগলো ওখানকার স্থানীয় মানুষজনের সাথে। সব দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বাবা এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো। মা ও আমরা তিন ভাই বোন এক জায়গায় কোন রকমে দাঁড়িয়ে আছি। কোন উপায়ান্তর না দেখে বাবা খুবই হতাশ হয়ে পড়ল। মায়ের মধ্যে সেরকম কোন চিন্তার লেশ দেখতে পেলাম না বরং বেশ খুশীই লাগছিল মাকে। মা ওর মধ্যেই বলতে লাগলো,--" চলো আজকের দিনটা বোনের বাড়ি ফিরে যাই।কালকে বরঞ্চ বাড়ি ফিরব।"

বাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। বলছিল,--" আশেপাশে কোন সস্তার হোটেল পেলে সেখানে একটা রাত কাটিয়ে দেবো।"

মায়ের সাথে বেশ মনোমালিন্য শুরু হলো বাবার। মা বলল,--" এটা কি শোভনীয়? বোনের বাড়িতে এসে এরকম বিপদ আসবে আমরা কি আর জানতাম? ও তো অনেক বার করে বলছিল আর দুটো দিন থেকে যেতে...."

বাবা তবুও ওদের বাড়ি ফিরে যেতে রাজী হচ্ছিল না। বারবার মায়ের অনুরোধে বাবার প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার সেই রিক্সা করে আমরা মাসিমনির বাড়ি ফিরে এলাম। আমাদের মনে তখন আনন্দের বন্যা...

কলিং বেল বাজানোর সাথে সাথে মাসিমনির দুই ছেলে -মেয়ে দরজা খুলে বাইরে এসে আমাদের দেখে জোরে জোরেই বলতে লাগলো,--"মা তোমার আরামে থাকা আর হয়েছে!আবার তোমাকে রান্না করতে হবে। ওই দেখো, মাসিমনিরা আবার সব একগুষ্টি ফিরে এসেছে! বাবা বলছিল না, আমাদের এত বড় বাড়ি দেখে ওরা সহজে আর যেতে চাইবে না। শেষমেশ বাবার কথাই মিলে গেল।"

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মায়ের মুখে যেন কেউ এক দোয়াত কালি ঢেলে দিয়েছে। একেবারে মুখটা চুন করে মা দাঁড়িয়ে আছে। বাবা হিম শীতল দৃষ্টি নিয়ে মায়ের দিকে তাকালো।

ওই বয়সেই আমি বুঝতে পারলাম, এগুলো মাসিমনির ছেলেমেয়েদের কথা নয়! আমরা বেড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে বড়দের কথা ওরা শুনেছে। সেগুলোই ওরা আমাদের সামনে বলেছে!

আমরা গরীব,তাই এত সস্তা! আমাদের নিয়ে যা খুশি ভাবা যায়! আমাদের নিয়ে যা খুশি বলা যায়! অথচ প্রতিবছর আমাদের বাড়িতে গিয়ে ওরা জগদ্ধাত্রী পুজোয় কত আনন্দ করে আসে!বাবা নিজের রোজগারের সবটুকু দিয়ে ওদের জন্য ভালো ভালো খাবার দাবার আনার ব্যবস্থা করে।

কিছুক্ষণ পরে মাসীমণি স্নান সেরে উপর থেকে নেমে এসে বলল,--" কি হলো দিদি? তোরা ফিরে এলি যে! রাস্তায় কিছু অসুবিধা হয়েছে?আয়,ভেতরে আয় "

বুঝতে পারলাম মা কান্নাটা কোনরকম আটকে বলল,--" স্টেশনে ঢোকার মুখে প্রচন্ড গন্ডগোল হচ্ছিল। তাই আমরা আর ফিরে যেতে পারলাম না। সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে।

মাসীমণি যেন অবিশ্বাসের সুরে বলল,"ওমা! তাই নাকি? আগে তো কখনো এরকম হয়নি। আমাদের এখানে তো পুলিশ খুব তাড়াতাড়ি অ্যাকশন নেয়।"

সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মেসো বলল,-- আপনাদের ট্রেন তো আরো ঘন্টা খানেক দেরিতে ছিল,তাই না? পুলিশ এখানে খুব তাড়াতাড়ি সবকিছু স্বাভাবিক করে দেয়! ঠিক আছে, ঘুরে এসেছেন যখন, চলে আসুন। আমাদের এত বড় বাড়িতে কোন অসুবিধা হবে না। তবে কিছুক্ষণ ওয়েট করলে সবকিছু নরমাল হয়ে যেত।"

সেই রাতে প্রথম দেখেছিলাম মা একদম চুপচাপ। আর কোন কথা বলেনি মাসিমানির সাথে। মাসিমনিও নিজের কাজ গোছানোর নাম করে বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত ছিল ও ছেলেমেয়েকে অকারনে ভীষণ বকাঝকা করছিল।

রাতটা কোনরকমে কাটিয়ে পরদিন ট্রেনের টাইমের অনেক আগে বাবা বেরিয়ে পড়ল। সারা রাস্তা মায়ের মুখে একটাও কথা শুনিনি। বাবা বরং দু চার বার মাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মায়ের এই অস্বাভাবিক শান্ত হয়ে থাকাটা আমার কেমন যেন একটু অন্যরকম লেগেছিল।

পরের বছর জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় মাসীমণি আসবে বলে, মাকে চিঠি লিখেছিল। মা সেই চিঠির জবাব দেয়নি। এরপর যতবারই মাসিমনির চিঠি এসেছে, মা সেই চিঠিগুলো পড়ার পরই কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আর কখনো মাসিমনির সাথে কোন যোগাযোগ রাখে নি।মায়ের চিঠি ছেঁড়ার সময় মুখের ভাবটা দেখে বুঝতে পারতাম, মায়ের মনটাকে যেভাবে দুমড়ে মুচড়ে সেদিন ওরা চুরমার করেছিল,মা যেন সেই রাগটা নিয়ে ওই চিঠিগুলো ছিঁড়ত।

ধীরে ধীরে আমরা বড় হলাম। আমি এখন এক সরকারী অফিসের কেরানী। বোন স্কুল শিক্ষিকা, ভাই বড় ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের কাছে বাবা-মা'ই জীবনের সর্বস্ব।

শুনেছি মাসিমনির ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করেছে, মেয়ের বিয়ে হয়েছে। মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছিল। আমরা কেউই যাইনি।

কিছুদিন আগে খবর পেলাম মাসিমনির ওই তিনতলা বাড়ি নিয়ে ওদের দুই ভাই বোনের মধ্যে ধুন্ধুমার লড়াই হচ্ছে। আইন আদালত করে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। মাসীমণি ও মেসোমশাই দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে একেবারে জেরবার। দুজনেই ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছে দুই ভাই বোনের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে।

মায়ের এক জেঠতুতো দাদার থেকে এই খবর শোনার পর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, মায়ের মুখটা যেন খুশীতে উজ্জ্বল। কোথাও একটা জিতে যাওয়ার হাসি প্রচ্ছন্নভাবে ঠোঁটের কোণায় লেগে আছে।

মায়ের সেই আনন্দে আমিও যে খুব খুশী হয়েছিলাম সেকথা আজ জানালাম।

コメント


bottom of page