top of page

সর্বানী গুহ - পাঙ্গারচুলা শিখরের হাতছানি



শহরের এই কোলাহল আর ব্যস্ত জীবন থেকে মাঝেমাঝে বেরিয়ে পড়ে নিরিবিলিতে কয়েকটা দিন পাহাড়ে কাটাতে পারলে বেশ ভালই লাগে। তবে আমার পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার থেকে ট্রেকিং করতে বেশী ভালো লাগে। তাই সুযোগ পেলেই ট্রেকিংয়ে বেরিয়ে পড়ে বন্ধুদের সাথে হেসে-খেলে কয়েকটা দিন বেশ কাটিয়ে দেওয়া যায়। শারীরিক কষ্ট খানিকটা থাকলেও প্রকৃতির ঐ নির্মল অকলুষিত মনোরম পরিবেশে সব কষ্ট কোথায় যেন বিলীন হয়ে যায়।

যাই হোক, আমাদের এবারের ট্রেকিংয়ে যাওয়াটা মোটেও খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। করোনা মহামারীর এই ভয়ঙ্কর ছোবলে গোটা বিশ্ব যখন ভীত এবং সন্ত্রস্ত, সেই সময় ট্রেকিংয়ে যাওয়ার কথা মাথায় আনাটাই বাতুলতা বই অন্য কিছু নয়। এরই মধ্যে আমরা নিজেদেরকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার কাজে নেমে পড়লাম। ঠিক তারই মাঝে আমি করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি। যদিও বিশেষ কোন শারীরিক অসুবিধা অনুভব করিনি, তবুও মনের ভিতরে একটা আশঙ্কা দানা বাঁধছিল যে এবারে আমি কি ট্রেকিংয়ে যেতে পারব না! সপ্তাহ দুই গৃহবন্দী জীবন কাটিয়ে পারিবারিক ডাক্তারবাবুর পরামর্শের পরে এবং ওনার সাথে কথা বলে আশ্বস্ত হবার পরেই নিশ্চিন্ত মনে আবার করে ট্রেকিংয়ের প্রস্তুতি পর্ব জোর কদমে শুরু করলাম।


আমাদের এবারের ট্রেকের গন্তব্য ছিল পাঙ্গারচুলা পর্বত শিখর এবং কূঁয়ারী পাস। সেইমত দিনক্ষণ ঠিক করে নিয়ে ট্রেনের টিকিটও কেটে ফেলা হলো। দ্বিতীয় ট্রেক হিসাবে পর্বত শিখর লক্ষ্যে রাখাটা; আমার কাছে নিতান্তই চ্যালেঞ্জ বললে কম বলা হবেনা। মানসিকভাবে নিজেকে তৈরী করতে থাকলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিতে শুরু করলাম।

অবশেষে সেই দিনটা চলে এল যার জন্যে আমরা সারা বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকি। একটা টাটা সুমো করে আমরা সবাই আসানসোল রেলস্টেশনে পৌঁছালাম। সেখান থেকে পূর্ব্বা এক্সপ্রেসে করে পরের দিন সকালে দিল্লী পৌঁছালাম। দিল্লী থেকে জনশতাব্দী এক্সপ্রেসে হরিদ্বার পৌঁছালাম। সেখানে প্রেমনগর আশ্রমে রাত্রিটা থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাত্রিটা ওখানে থেকে পরেরদিন ভোর পাঁচটা নাগাদ আশ্রম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়ী আগে থেকেই বলে রাখা ছিল। সময়মত গাড়ী চলেও এল। গাড়ীর মাথায় আমাদের সবার মালপত্র চাপিয়ে দিয়ে রওনা দিলাম যোশীমঠের উদ্দেশ্যে। হরিদ্বার থেকে যোশীমঠের দূরত্ব প্রায় 280 কি.মি.। পাহাড়ি রাস্তায় সময় লাগে প্রায় 12-13 ঘন্টা। যোশীমঠ যাওয়ার পথে চারটে প্রয়াগ পড়ে। “প্রয়াগ” কথার অর্থ হল - দুটো বা তার বেশী নদীর সংযোগস্থল। প্রথম প্রয়াগ হলো দেবপ্রয়াগ - যা ভাগিরথী আর অলকানন্দা-দুই নদীর মিলিত ধারা। ভাগিরথী হলো গঙ্গার মূলধারা যা দেবপ্রয়াগের পর গঙ্গা পরিচিতি নিয়ে বয়ে চলেছে সাগরের দিকে। এর পর রুদ্রপ্রয়াগ - এটি মন্দাকিনি ও অলকানন্দা নদীর মিলনস্থল। এরপর হলো কর্ণপ্রয়াগ – পিণ্ডার ও অলকানন্দার সংযোগস্থল। পিণ্ডারের উৎপত্তিস্থল পিণ্ডার হিমবাহ (glacier) - যেটা নন্দাদেবী পর্বতের পাদদেশে। সব শেষে নন্দপ্রয়াগ – মন্দাকিনি ও অলকানন্দা - এই দুই নদীর মিলনস্থল হিসাবে পরিচিত। আমরা দেবপ্রয়াগ পার হয়ে একটা হোটেলে জলখাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম করে নিয়ে আরও এগিয়ে চললাম। কর্ণপ্রয়াগ পার করে দুপুরের খাবার খেয়ে আর কিছু ছবি তুলে নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। সূর্য যখন প্রায় অস্তাচলে, বিকেল পাঁচটায় অবশেষে আমরা যোশীমঠ পৌঁছালাম।

যোশীমঠ, উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার অন্তর্গত, পাহাড়ে ঘেরা খুব সুন্দর একটা শহর। যোশীমঠ কূঁয়ারী পাস, পাঙ্গারচুলা শিখর ট্রেক,বাঘিনী হিমবাহ ট্রেক, ভ্যালী অফ ফ্লাওয়ার্স এবং আরও অনেক ট্রেকের বেসক্যাম্প হিসেব পরিচিত। এটা অনেক তীর্থক্ষেত্র, যেমন বদ্রীনাথ, এবং আউলির মত, অনেক সুন্দর জায়গার প্রবেশদ্বার।

আমরা যোশীমঠে একটু চা-টিফিন খেয়ে এগিয়ে চললাম ঢাকের উদ্দশ্যে। যোশীমঠ থেকে ঢাকের দূরত্ব প্রায় 11-12 কি.মি.। প্রায় সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আমরা ঢাকে পৌঁছালাম। চারিদিকে অন্ধকার; কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। যেখানে আমাদের জন্য টেণ্ট লাগানো হয়েছিল, গাড়ী অতদূর পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাই ঐ অন্ধকারের মধ্যে টর্চের আলোতে পাহাড়ি রাস্তা ধরে হেঁটেই আমরা টেণ্টে পৌঁছালাম।


টেণ্টের কথা আগে আমি অনেক শুনেছিলাম; কিন্তু বাস্তবে সেটা কেমন হয় সেদিন প্রথম চোখের সামনে দেখে বেশ ভালো লাগলো। মোট চারটে টেণ্ট ছিল; আমাদের জন্য দুটো টেণ্ট, একটা কিচেন টেণ্ট, আর একটা টয়লেট টেণ্ট-যেটা আমাদের টেণ্টের থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছিল। সারাদিন 12-13 ঘণ্টা গাড়ীতে যাত্রা করে আমরা খুব ক্লান্ত ছিলাম। তাই তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। কারণ পরের দিন সকাল থেকে আমাদের ট্রেকিং শুরু। ঢাক থেকেই এই ট্রেকিং শুরু হয়। তাই আমরা সেইদিন যোশীমঠে না থেকে একটু এগিয়ে ঢাক অবধি চলে এসেছিলাম।

আজ আমাদের ট্রেকিংয়ের প্রথম দিন। সকালবেলা পাহাড়ের কোলে সুন্দর সূর্যোদয় দেখে আমাদের দিন শুরু হল। ঢাক, পাহাড়ের কোলে একটা ছোট্ট সুন্দর গ্রাম। চারিদিকে তাকালে শুধু উঁচু উঁচু পর্বতমালা, সে এক আশ্চর্যজনক দৃশ্য – চোখ না দেখে বোঝানো সম্ভব নয়। সকালে চা এবং ব্রেকফাস্ট খেয়ে আমরা সবাই তৈরী হয়ে নিলাম। শুরু হলো আমাদের পথচলা। ট্রেকিংয়ের শুরু থেকে আমাদের গন্তব্য - পাঙ্গারচুলা শিখর - আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান ছিল। আমাদের আজকের গন্তব্য ছিল গুলিং টপ, দূরত্ব প্রায় 6-7 কি.মি. এবং উচ্চতা প্রায় 9,000 ফুট।

পাহাড়ি রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে খাদ; কোথাও ছোট ছোট ঝর্ণার জলস্রোতের উপর দিয়ে, কোথাও ছোট ছোট বোল্ডারের তৈরী রাস্তা, আবার কোথাও মাটির রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। ঢাক থেকে গুলিং টপ যেতে চারটে ছোটো ছোটো গ্রাম পড়ে – কার্চি, তুগাসী, রায়গিরি এবং কার্ছাং। প্রায় অর্ধেক রাস্তা চলার পর আমরা তুগাসী নামে ছোট্ট গ্রামে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার এগিয়ে চললাম আমাদের আজকের গন্তব্যের দিকে। এই চলার পথে আছে অসাধারণ সুন্দর বড় বড় সবুজ মাঠ, সুন্দর সুন্দর নাম না জানা অনেক গাছপালা এবং অনেক ছোট ছোট ঝর্ণা। এসব দেখতে দেখতে আমরা দুপরবেলার মধ্যেই গুলিং টপ পৌঁছে গেলাম।

আমাদের গাইড, তার দলবল নিয়ে, আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। ওরা এসেই সব টেণ্ট রেডি করে রেখেছিল; সঙ্গে গরম গরম স্যুপের সাথে লাঞ্চও তৈরী করে রেখেছিল। আমরা পৌঁছে গরম গরম খাবার খেয়ে নিলাম। তারপর পাহাড়ের কোলে সেই মনোরম পরিবেশে বসে সবাই আড্ডা দিতে দিতে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এল। সঙ্গে ঠাণ্ডার প্রকোপও বাড়তে লাগল। সবাই আবার টেণ্টে ফিরে গরম গরম স্যূপ, ম্যাগি খেয়ে একটু গল্প করে ডিনার সেরে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কারণ পরের দিন সকাল সকাল বেরোতে হবে আমাদের।

আজ আমাদের ট্রেকিংয়ের দ্বিতীয় দিন। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়লাম আর অসাধারণ সূর্যোদয় দেখে মন ভরে‌ গেল। ধীরে ধীরে সূর্যের রশ্মিচ্ছটা যখন বরফে ঢাকা পাহাড়ের উপর পড়ে স্বর্ণালী এক বরণ ধারণ করল-সে এক অপরূপ দৃশ্য। সামনের থেকে চোখে না দেখলে অনুভব করা সম্ভব নয়। আর জায়গাটা ও আশেপাশের দৃশ্য ফটোগ্রাফির জন্য আদর্শ। এবার আমরা ব্রেকফাস্ট খেয়ে তৈরী হয়ে নিলাম। আমাদের আজকের গন্তব্য হল লোয়ার খুল্লারা ক্যাম্পসাইট যার উচ্চতা প্রায় 11,200 ফুট।

সকাল আটটা নাগাদ আমরা হাঁটা শুরু করলাম। আজকের রাস্তাটা ছিল পুরোটাই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। ধীরে ধীরে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম। চারিদিকে অনেক উঁচু উঁচু গাছ যেগুলো সমতলে দেখা যায়না। 8,000 ফুট উচ্চতা থেকে এদের দেখা মেলে। শুধু তাই নয়, সেগুলো খুব মূল্যবানও। ছোটছোট রডোডেণ্ড্রণের গাছও দেখতে পেলাম। যেহেতু নভেম্বর মাসে গিয়েছিলাম, তাই রডোডেণ্ড্রণের ফুলের দেখা এবারও মেলেনি। এই জঙ্গলের পরিবেশটা তেমন গা-ছমছমে নয়, তবুও চারিদিকে বিভিন্ন রকমের আওয়াজ, সঙ্গে নাম না জানা অনেক পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছিল। কোথাও ছোট ছোট ঝর্ণার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে কিছু অদৃশ্যই থেকে গেলো আর যেগুলো দৃশ্যমান হলো সেগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটার উপর বড় বড় গাছের গুঁড়ি পড়েছিল; যার উপর দিয়ে অতি সন্তর্পণে পার হতে হয়েছিল। এখান থেকেই অল্প অল্প বরফের দেখা পেলাম। এইভাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে এবং উপভোগ করতে করতে দুপুর দুটো নাগাদ আমরা লোয়ার খুল্লারা পৌঁছালাম।


নির্ধারিত সময়ের বেশ খানিকটা আগেই আমরা ক্যাম্পসাইটে পৌঁছে গেলাম। বৃক্ষরাজির সীমানা ছাড়িয়ে 11,000 ফুট উপরে চারিদকে বরফে ঢাকা পর্বতশ্রেণীর মাঝে দাড়িয়ে সে এক অদ্ভূত অনুভব নিজের চোখে না দেখলে ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। যাইহোক এরপর গরম গরম স্যুপের সাথে লাঞ্চ সেরে ফেললাম। এরপর সবাই মিলে একটু ক্রিকেট খেললাম। ধীরে ধীরে সূর্য ঢলে পড়ল পাহাড়ের কোলে। সূর্য ডোবার সাথে সাথেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লাগছিল বলে সবাই আমরা টেণ্টে ফিরে এলাম। রাত্রে আনুমানিক তাপমাত্রা শূণ্যের নীচে দুই ডিগ্রী। পরের দিন আমাদের আসল ট্রেক পাঙ্গারচুলার চূড়ায় আরোহণ; প্রায় রাত্রি দুটোয় উঠে তিনটের মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে - 14-15 ঘণ্টা হাঁটা। তাই তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।


আজ আমাদের ট্রেকিং-এর তৃতীয় দিন। আজকের দিনটা এবারের ট্রেকিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন কারণ আজকের হাঁটাটা সবচেয়ে কষ্ট সাধ্য এবং রাস্তাটাও বেশ কঠিন। আমাদের গাইড রাত্রিবেলা থেকে আমাদের জন্য ব্রেকফাস্ট এবং পরের দিন সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার লাঞ্চ তৈরী করে সঙ্গে নিয়েছিল কারণ আজকের দিনটা পুরোটা আমাদের পথেই কেটে যাবে। এরপর আমাদের প্রায় সাড়ে চারটে বেজে গেলো বেরোতে বেরোতে পাঙ্গারচুলার উদ্দেশ্যে। চারিদিকে ঘন কালো অন্ধকার, কিছুই ঠিক করে দেখা যাচ্ছিল না। হেড টর্চের সাহায্যে পখ যতটুকু দেখা যাচ্ছিল তাতেই এগিয়ে চললাম। ছোটো ছোটো বোল্ডারের খাড়াই রাস্তা, চলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। মাঝেমাঝে সেই বোল্ডারের উপর ছিল অল্প বরফের আস্তরণ যাতে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। লাঠির সাহায্যে ধীর গতিতে এগিয়ে চললাম। এইভাবে 2-2½ ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা গেইলগড় পৌঁছালাম যেখান থেকে একদিকের রাস্তা পাঙ্গারচুলা আর আরেক দিকের রাস্তা কূঁয়ারী পাস চলে যাচ্ছে।

রাত শেষ হয়ে দিগন্তে ভোরের আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়তে লাগল প্রথমে চৌখাম্বা এবং নীলকণ্ঠ পর্বতের চূড়ায় আর তারপর আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ল হাতি-ঘোড়ি পর্বত ও ত্রিশূল পর্বতশৃঙ্গের উপর। পর্বত চূড়াগুলো যখন স্বর্ণবর্ণ ধারণ করল সে এক অনির্বচনীয় দৃশ্য এবং অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা। এরপর সামনের রাস্তা আরও কঠিন হতে লাগল। 11,200 ফুট থেকে 14,700 ফুট - মানে একদিনে প্রায় 3500 ফুট উপরে ওঠা। একদিনে এতটা উচ্চতা পার করাটা ভীষণ কঠিন ও কষ্টসাধ্য। বরফাবৃত পাহাড়ি রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটা শুরু হল। প্রথমে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। কোথাও অর্ধশক্ত আবার কোথাও শক্ত বরফে ঢাকা। তাই চলতে চলতে কোথাও কোথাও পিছলে পড়ছিলাম; আবার কোথাও পা বরফের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। ক্র্যাম্পন (Crampon) না পরে হাঁটা অসম্ভব ছিল। জীবনে প্রথমবার এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। একদিকে মনে ভয় এবং আর একদিকে ভালোলাগা- দুই নিয়ে এগিয়ে চললাম। সঙ্গে তেমন ঠাণ্ডা হাওয়া। প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগেছিল আমাদের ঐ বরফাবৃত পাহাড় পার করতে। এরপর একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার এগিয়ে চলা।

এরপর পাহাড়ের খুব সরু পাকদণ্ডী দিয়ে এগিয়ে চললাম। একদিকে পাহাড় আর একদিকে খাদ- রাস্তাটা বড় জোর আধা ফুট মত চওড়া হবে। ছোটো ছোটো রডোডেণ্ড্রণের গাছ ধরে ধরে অতি সন্তর্পণে এগিয়ে চললাম। কারণ একটু অসাবধান হলেই নীচে খাদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।


এরপর এসে পড়লাম বোল্ডার আবৃত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে – এক কথায় যাকে বোল্ডারের সমুদ্র বলা যেতে পারে। নভেম্বরের শেষদিক থেকে মে মাস পর্যন্ত এগুলো বরফে ঢাকা থাকে। কিন্তু আমরা যখন পৌঁছালাম তখন সেগুলো অল্প বরফের আস্তরণে ঢাকা ছিল। বোল্ডারগুলো এমনভাবে বিছানো যে তার মাঝে মাঝে এক-মানুষ সমান গভীর খাদ। পা পিছলে পড়লে হাত-পা ভেঙ্গে পড়ে যাওয়ার পুরো সম্ভাবনা। আবার পায়ে ক্র্যাম্পন পরে থাকার জন্য বোল্ডারের উপর পা পিছলে যাওয়ার ভয়; আবার ক্র্যাম্পন ছাড়া হাঁটলে বরফে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয়। সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম।

জীবনে প্রথম সেদিন মৃত্যুভয় অনুভব করেছিলাম। যাই হোক লাঠি এবং বন্ধুদের সাহায্যে ধীরে ধীরে প্রায় 2- 2 ½ কিমি. বোল্ডার জোন পেরিয়ে আমরা পাঙ্গারচুলার বেসক্যাম্পে পৌঁছালাম। চলতে চলতে বেশ কয়েকবার পড়েও গিয়েছিলাম। একবার ঐ বোল্ডারের খাঁজেও পড়ে গেছি। যাইহোক পাঙ্গারচুলা বেসক্যাম্প অবধি পৌঁছাতে আমাদের বেশ দেরী হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি আর আরও কয়েকজন বন্ধু এগোলাম না, কিন্তু আমাদের দুই বন্ধু এগিয়ে গেল পাঙ্গারচুলা শিখর জয় করতে। ওদের পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ নেওয়া ছিল। আর আমরা যারা পারলাম না, তারা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে লোয়ার খুল্লারা ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে ফিরতে শুরু করলাম। ঐ ভয়ঙ্কর বোল্ডার জোন পেরিয়ে, আবার সেই একই পথে প্রায় 18 ঘণ্টা পরে রাত্রি ন’টা নাগাদ লোয়ার খুল্লারা ক্যাম্পে ফিরলাম।

ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর নিয়ে ফিরেছিলাম ঠিকই, কিন্তু মনে ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তাও ছিল ওই দুই বন্ধুর জন্য, যারা শিখর জয়ের উদ্দ্যেশ্যে এগিয়ে গিয়েছিল। রাতের খাবার খেয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম, কিন্তু সারারাত ওদের ফেরার অপেক্ষায় উদ্বিগ্ন ছিলাম। কখন যে চোখের পাতা বুজে এসেছিল বুঝতে পারিনি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি সকাল হয়ে গেছে। তখনও ওদের কোন খবর নেই। অবশেষে সকাল ন’টায় দূর থেকে ওদের গলার আওয়াজ পেয়ে মনে একটু স্বস্তি পেলাম। ওরা দুজনে আর গাইড সাফল্যের সাথে শিখর জয় করেছিল ঠিকই; কিন্তু প্রায় 29 ঘণ্টা ধরে বিনা জল ও খাবারে সারারাত ধরে ঐ ভয়ঙ্কর বোল্ডার এলাকা পেরিয়ে ওরা যে সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছিল, সেটা ঈশ্বরের একটা বড় আশীর্ব্বাদ ছাড়া আর কিছু নয়। ওরা খুবই ক্লান্ত আর দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তারমধ্যে ঐ অন্ধকারে ওরা পথও হারিয়ে ফেলেছিল। যাই হোক দীর্ঘ 29 ঘণ্টা হাঁটার পরে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে ওরা গরম স্যূপ আর টিফিন সেরে যে যেখানে পারল রোদের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। আমাদের সেদিন কূঁয়ারী পাস যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিল করে ওই দিনটা ওখানে সবাই বিশ্রাম নিলাম। সন্ধ্যায় বনফায়ারের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডাতে বেশ ভালোই লাগছিল। একটু হাসি-মজা করে বনফায়ারের পাশে ডিনার করে টেণ্টে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।


আজ আমাদের ট্রেকিং এর পঞ্চম দিন। আজ আমাদের গন্তব্য কূঁয়ারী পাস হয়ে টালি নামক একটি গ্রাম যেখানে আমরা রাত্রিযাপন করব। চলার রাস্তা প্রায় 11-12 কি.মি.। ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম কূঁয়ারী পাস-এর উদ্দেশ্যে। পাস কথার অর্থ হল গিরিপথ। লর্ড কার্জন ভারতে এসে অনেক কাজ করেছিলেন; যার মধ্যে একটা অসামান্য কাজ করেছিলেন যা কিনা এই কূঁয়ারী পাসের রাস্তাটা তদানিন্তন চীন দেশের সাথে বাণিজ্যক কারণের জন্য আবিষ্কার করেছিলেন। সেই জন্য এই কূঁয়ারী পাস ট্রেকের প্রাচীনকালের এক নাম হল লর্ড কার্জন ট্র্যেইল।


লোয়ার খুল্লারা ক্যাম্পসাইট থেকে আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম কারণ প্রথম 1½ -2 কি.মি. রাস্তা বেশ খাড়াই। ওখান থেকে চারটে রাস্তা ভাগ হয়ে যায়: পাঙ্গারচুলা, খুল্লারা, কূঁয়ারী পাস ও টালি গ্রাম। গেইলগড়ে পাহড়ি দেবতার মন্দিরে দর্শন করে আমরা এগিয়ে চললাম কূঁয়ারী পাসের দিকে। তবে পাহাড়ের মন্দির সমতলের মত হয়না। ওখানে বিভিন্ন মাপের পাথর সাজিয়ে তার উপর পতাকা লাগানো থাকে। ওটাই ঈশ্বরের প্রতীক। কূঁয়ারী পাসের উচ্চতা সমতলের তুলনায় প্রায় 12,500 ফুট। কূঁয়ারী পাস দুই পাহাড়ের সংযোগস্থলে একটা ফাঁকা জায়গা। অসামান্য প্রকৃতির মধ্যে দিয় হাঁটা। হালকা হালকা বরফ, কোথাও কোথাও পাহাড়ের রিজ (Ridge) ধরে হাঁটা। কোথাও ছোটো ছোটো ঝর্ণা, তার উপর হালকা বরফ জমা, যার উপর দিয়ে হাঁটতে গেলে পা পিছলে খাদে পড়ে যাওয়ার ভয়। এইভাবে বেশ কিছু চড়াই উৎরাই পথ ধরে চলতে চলতে আমরা কূঁয়ারী পাস পৌঁছালাম। পথে কিছু স্থানীয় রাখালের সাথে দেখা হলো। কূঁয়ারী পাস থেকে গাড়োয়াল হিমালয়ের অনেক পর্বত শৃঙ্গের দেখা পাওয়া যায় যেমন কেদারনাথ, চৌখাম্বা, নীলকণ্ঠ, হাতি পর্বত, ঘোড়ি পর্বত, দূনাগিরি, কামেট, মানা, নন্দাঘুঁটি, নন্দাদেবী, তৃশূল এর মধ্যে প্রমুখ। এই সব পর্বত যেন চোখের সামনে তাদের নিজস্ব সৌন্দর্য নিয়ে দাড়িয়ে রয়েছে নিস্তব্ধ হয়ে। সে এক ঐশ্বরিক দৃশ্য। দুচোখ ভরে দেখলাম আর উপভোগ করলাম।


আমরা ওখান থেকে প্রায় 1½ কিমি. হেঁটে কূঁয়ারী পাস ভিউ পয়েণ্ট গেলাম। ওখানে পৌঁছে সবাই আমরা একটু ছবি তুললাম। খুব কমই, কারণ ব্যাটারীতে চার্জ খুব কম ছিল। তারপর ওখানের মন্দিরে একটু ধূপ জ্বেলে ধীরে ধীরে ঐ একই পথে ফিরে এলাম। ফেরার সময় আবহাওয়া হঠাৎ করেই একটু খারাপ হয়েছিল; তার সাথে ছিল ঠাণ্ডা হাওয়ার তীব্রতা। এখান থেকে টালি গ্রামের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম। প্রায় 8-9 কি.মি. হাঁটা। কিছুটা চলার পর একটা জায়গায় আমরা বিশ্রাম করলাম। প্রত্যেক দিনের ট্রেকে আমাদের সঙ্গের গাইড দুপুরের টিফিন সঙ্গে নিয়েই যেত। আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে আবার এগিয়ে চললাম। খুব সুন্দর টালি লেককে এক পাশে রেখে বেশীর ভাগ রাস্তাটাই ছিল পাহাড়ের রিজ ধরে হাঁটা, তার সাথে প্রচণ্ড হাওয়ার দাপট। এইভাবে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে করতে এবার একটা জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। জঙ্গলটা খুব ঘন ছিল না। পাহাড়ের উচ্চতায় যে সব গাছ হয় পাইন, ফার - এরকম সব বড় বড় গাছ। কূঁয়ারী পাস থেকে প্রায় 2,000 ফুট নেমে আসার ফলে চারিপাশে বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছিল কারণ সূর্য উঁচু পাহাড়ের পিছনে প্রায় হারিয়ে গেলে, বেশ একটা গা-ছমছমে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ক্রমশ নীচের দিকে নামছিলাম বলে আমাদের চলার গতিও দ্রুত হতে লাগল।

প্রায় চারটে নাগাদ আমরা ক্যাম্পসাইটে পৌঁছালাম। ওখানে পৌঁছে প্রথমে গরম স্যূপ আর ম্যাগী খেয়ে ক্লান্ত শরীরে একটু স্বস্তি পেলাম। যেখানে আমাদের টেণ্ট লাগানো হয়েছিল জায়গাটা অদ্ভূত সুন্দর। চারিদিকে বড় বড় পাহাড়ি গাছের জঙ্গল, জঙ্গলের নিস্তব্ধতা যেন সব গ্রাস করে নিচ্ছিল। নিস্তব্ধতারও একটা অদ্ভূত অনুভূতি আছে। আর হঠাৎ হঠাৎ সেই স্তব্ধতাকে ভেদ করে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছিল। চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এল, আমরা টেণ্টে ফিরে এলাম। টেণ্টের ভিতরে বসে আবার গরম স্যূপ-চা-পপকর্ণ খেয়ে বেশ গল্পগুজব করলাম। সেদিন আর ঘুমানোর তাড়া ছিলোনা, কারণ এবার নামার পালা-বেশী সময়ও লাগবে না। তারপর বনফায়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে বসে গাইড এবং আমরা সবাই মিলে পাহাড়ের অনেক গল্পগুজব করে একসাথে ডিনার সেরে যে যার টেণ্টে চলে গেলাম।


তবে আর একটা অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়নি। যে কোনো ট্রেকিংয়েই থাকার টেণ্ট যেখানে তৈরী করা হয়, সেখান থেকে টয়লেট টেণ্টটা বেশ খানিকটা দূরে থাকে। রাতের ওই ঘন অন্ধকারে শুধু টর্চের আলোর সাহায্যে সেখানে যাওয়াটা একটা বিরাট ভয়জনিত অভিজ্ঞতা। সেটা বাস্তবে না গেলে ঠিকভাবে বোঝানো যাবেনা। গাইড আমাদের গল্প বলেছিল যে একজন এইরকম রাত্রের অন্ধকারে টয়লেট টেণ্টের থেকে ফেরার পথে দিগভ্রান্ত হয়ে জঙ্গলের অন্ধকারে অন্যদিকে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। সেটা শুনে বেশ ভয় লেগেছিল। এরপর আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন বেশ ভোরভোর উঠে পড়লাম। টালি জায়গাটা ভারি সুন্দর। আমার নিজস্ব মতামত যে এই জায়গাটাকে এক-কথায় ট্রেকিংয়ের স্বর্গ বললে মন্দ হয়না। সবাই মিলে বেশ অনেক ছবি তুলে ব্রেকফাস্ট করে তৈরী হয়ে নিলাম। গাইডরা নিজেদের সব জিনিসপত্র বেঁধে নিল। ওদের জিনিষপত্রগুলো ছোট পাহাড়ি ঘোড়ার পিঠে বেঁধে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা নিয়ে যাওয়া হ’ত। আমরা ন’টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম।


আজ আমাদের ট্রেকিংয়ের ষষ্ঠ দিন। আজকের গন্তব্য গার্সন বুগিয়াল-প্রায় 11 কি.মি. হাঁটা। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ কিছুদূর হাঁটার পর শুরু হলো পাহাড়ের পাকদণ্ডি রাস্তা। পাহাড়ের গা দিয়ে সরু রাস্তা – একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে গভীর খাদ - কোথাও ছোটো ছোটো বোল্ডার, আবার কোথাও বালির রাস্তা। পা পিছলে গেলে একেবারে খাদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। পাহাড়ের গা ধরে ধরে অতি সন্তর্পণে এগিয়ে চললাম। কোথাও গাইড-এর সাহায্যে আবার কোথাও বসে বসে পার হতে হচ্ছিল। রাস্তা বেশ কঠিন ছিল আর ভয়ও লাগছিল। এইভাবে বেশ অনেকটা পথ পেরিয়ে একটা জায়গায় কিছুক্ষণ বিশ্রামের জন্য বসা হল। দুপুরবেলার খাবারও একইসাথে সেরে ফেলা হল সেখানেই। এবারে শুরু হলো বুগিয়ালের উপর দিয়ে হাঁটা। বুগিয়াল কথার অর্থ হলো পাহাড়ের মাঝে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছোটো ছোটো ঘাসে ঢাকা সবুজ মাঠ। যেন মনে হয়েছিল চারিদিকে সবুজ কার্পেট বিছানো। এরকম একটা সবুজ মাঠ যেখানে পাহাড়ি গরু, ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে আর যেখান থেকে হিমালয় পর্বতমালার অনেকগুলো উঁচু উঁচু চূড়া পরিষ্কার দেখা যায়। প্রায় 11,400 ফুট উচ্চতায় এরকম সুন্দর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখলাম যেটা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। এইভাবে দেখতে দেখতে আমরা বুগিয়াল পেরিয়ে আমাদের ক্যাম্পসাইটে পৌঁছে গেলাম প্রায় দুপুর তিনটে নাগাদ।

এখন বুগিয়ালে টেণ্ট লাগানো বারণ বলে আমাদের টেণ্ট লাগানো হয়েছিল বুগিয়াল আর জঙ্গলের সংযোগস্থলে। আজ আমাদের ট্রেকিংয়ের শেষদিন। তাই সবাই মিলে আনন্দ করে দিনটা কাটালাম। এরপর রাত্রে ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন ফেরার পালা। তবে টেণ্টে থাকার অভিজ্ঞতাটা বেশ ভালোই লাগলো। পাহাড়ের মাঝে ওই নির্জন পরিবেশে একটা ছোট্ট টেণ্টে ছোট ল্যাম্পের আলোতে থাকা, তার মধ্যেই সব কাজ করা অদ্ভূত ভালো লাগলো। বড় বড় হোটেল ছাড়াও যে আনন্দে থাকা যায় – এ এক নতুন উপলব্ধি হলো। এবারে ফেরার পালা। নিজেদের সব জিনসপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আউলির উদ্দেশ্যে।

গার্সন বুগিয়াল থেকে আউলির দূরত্ব তিন কিমি.। সামনে একটা পাহাড়ি দেবতার মন্দির ছিল। ওখানে ঠাকুর দর্শন করে বেরিয়ে পড়লাম। সে সময় রোপওয়ে বন্ধ ছিল, তাই আমরা বাকি পথ হেঁটেই গেলাম। আমরা একটা বড় মাঠ পার হলাম যেখানে শীতকালে পুরোটাই বরফে ঢাকা থাকে। পর্যটকরা এখানে শৈত্যকালীন ক্রীড়াপ্রতিযোগিতা যেমন আইস-স্কেটিং উপভোগ করেন। আউলি খুব সুন্দর একটা পর্যটন স্থল - একে ভারতের মিনি সুইজারল্যাণ্ডও বলা হয়। আউলির ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড থেকে আমরা গাড়ি ধরেছিলাম হরিদ্বার আসার জন্য। গাড়িতে ওঠার সময় আমাদের গাইড এবং তার সহযোগীদের বিদায় জানালাম। এই কদিনে আমরা এক পরিবারের মত হয়ে গিয়েছিলাম।


মনটা বেশ ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো। ন’টা নাগাদ হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। এরপর পথে এক জায়গায় থেমে ব্রেকফাস্ট, তারপর কর্ণপ্রয়াগে এসে লাঞ্চ সারলাম। যাওয়ার সময় যতটা উৎসাহ নিয়ে গিয়েছিলাম, ফেরার সময় সবার ততটাই মন খারাপ ছিল। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ হরিদ্বার স্টেশনে পৌঁছালাম। তারপর বাজারে একটু ঘোরাঘুরি করে রাতের খাবার খেয়ে রাত্রি 11:30 নাগাদ ট্রেনে উঠে পড়লাম দিল্লীর উদ্দেশ্যে। দিল্লী থেকে যে যার বাড়ির দিকে চলে গেলাম আর আমরা রাজধানী এক্সপ্রেস ধরে আসানসোল পৌঁছালাম।

একটা অসামান্য অভিজ্ঞতা সাথে নিয়ে ফিরলাম। অনেকগুলো ট্রেক করার পর সাধারণত: সবাই এই ট্রেকটা করে থাকে। আমার যে দ্বিতীয় ট্রেকিংয়ে এই পাঙ্গারচুলা শিখর জয় হয়ত হলোনা; তবু ওই বেসক্যাম্প অবধি পৌঁছানোটাও আমার কাছে অন্তত: সাফল্যের চেয়ে কম কিছু নয়! যাই হোক এতটা করতে পেরেও বেশ খুশী হয়েছিলাম।

আবার পরের ট্রেকিং এর অপেক্ষায় রইলাম...

 
 
 

Comentarios


bottom of page